২৭ মে ২০২৩, শনিবার, ১২:৩৬

হামলা-মামলা সংঘর্ষ ও ধরপাকড় বেড়েছে

বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিকে ঘিরে দেশের বিভিন্নস্থানে হামলা-সংঘর্ষ ও ধরপাকড়ের ঘটনা বেড়েছে। গত কয়েকদিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় হামলা ও সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবারও কেরানীগঞ্জ এবং খাগড়াছড়িতে বিএনপি নেতাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। কেরানীগঞ্জে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে দলটির নেতাকর্মীদের সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বিএনপির ঢাকা জেলা সাধারণ সম্পাদক নিপুন রায় চৌধুরীসহ উভয়পক্ষের অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। একই দিন খাগড়াছড়িতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের গাড়িবহরে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সহসভাপতি ক্ষেত্র মোহন রোয়াজাসহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। এরআগে রাজধানীর নিউমার্কেট থানার সায়েন্সল্যাব এলাকায় বিএনপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সঘংর্ষ হয় বিএনপির নেতাকর্মীদের। এ সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ দলটির ৪৬ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ অন্তত ৬০০ জনের বিরুদ্ধে থানায় তিনটি মামলা করা হয়েছে। এ মামলায় বর্তমানে ১২ জন পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধরপাকড় বাড়ার আশঙ্কাও বাড়ছে। বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীরা অভিযোগ করছেন ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। এ কারণে নতুন করে একের পর এক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পুরনো মামলায় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সামনের দিনে গ্রেপ্তার-ধরপাকড় আরও বাড়বে এমন আশঙ্কা থেকে নেতাকর্মীরা সতর্কভাবে চলাফেরা করছেন। বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, নেতাকর্মীদের নামে দিন দিন মামলার সংখ্যা বেড়েই চলছে। ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ২২মে পর্যন্ত ১৪ বছরে মামলা হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৫৬৭ টি। এসব মামলায় আসামী করা হয়েছে ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ৮২৬ জনকে। বিএনপির দাবি এসব মামলা মিথ্যা এবং হয়রানিমূলক। অনেককে গায়েবি আসামী করা হয়েছে। বিএনপি দলীয় সূত্রের দাবি ১৪ বছরে হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৫৩৭ জন। এরমধ্যে ৭৯৯ জন বিএনপি নেতাকর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত দলটির ৭২জন নেতাকর্মীর খোঁজ মিলছে না বলে জানিয়েছেন নেতারা। তাদের ভাষায় এইসব নেতাকর্মী ‘গুমের’ শিকার হয়েছেন।

২০২২ সালের ২২ আগস্ট থেকে চলতি মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ১ হাজার ৭৯০ জন বিএনপি নেতাকর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা গুরুতর জখম ও আহত হয়েছেন বলে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানিয়েছে। গত ১৫ রমযান থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে সারা দেশে শতাধিক মামলা করা হয়েছে। সেসব মামলায় প্রায় ৯ হাজার জনকে আসামী করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামী করা হয়েছে আরও কয়েক হাজার। নতুন মামলা ছাড়াও বিগত দিনের পুরনো মামলাতে আটক হতে হচ্ছে নেতাকর্মীদের। এছাড়া উচ্চ আদালত থেকে জামিন শেষে নি¤œ আদালতে হাজির হলে কারাগারে পাঠানোর সংখ্যাও বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। ঢাকা মহানগর বিএনপিতে নতুন আতঙ্ক সাদা পোশাকের পুলিশ। মামলাতে জামিন থাকলেও সাদা পোশাকে নেতাকর্মীদেরকে আটকের অভিযোগ করে আসছে বিএনপি। নেতারা জানান, ২০১৩, ২০১৫ ও ২০১৮ সালের মতো আবারো ধরপাকড় শুরু করেছে সরকার। গায়েবি মামলা দেয়া হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকায় নতুন মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীদেরকে আসামী করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পুরনো মামলায় জামিনে থাকলেও আটকের ঘটনা ঘটছে। বাসাবাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেকেই ঘরবাড়ি কিংবা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সব মামলায় জামিনে থাকলেও সম্প্রতি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুকে আটক করে ডিবি পুলিশ। পল্টন থানার একটি পেন্ডিং মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে একদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। একইভাবে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোয়াজ্জেম হোসেন মতিকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ।

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য আবুল হোসেনকে বাসায় না পেয়ে তার দুই পুত্র আব্দুর রহমান রনি ও আহাদুল ইসলাম বাদলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এছাড়া রামপুরা থানা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি সোবহান পাটোয়ারী ও ইয়াসিন আলী রনিকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ আটক করে।

এদিকে গত ২৩ মে বিএনপির পদযাত্রা থেকে পুলিশের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। মামলায় বিএনপির ৪৬ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে আরও ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামী করা হয়েছে। মামলার বাদী উপপরিদর্শক (এসআই) সবুজ মিয়া। এর আগে বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কেন্দ্রীয় নেতা শেখ রবিউল আলমসহ ৫২ জনের নাম উল্লেখ করে ধানমন্ডি থানায় মামলা করে পুলিশ। ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়া বলেছেন, বিএনপির পদযাত্রা থেকে পুলিশের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। মামলায় বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা শেখ রবিউল আলমসহ ৫২ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরও অনেককে আসামী করা হয়েছে। ওসি বলেছেন, সংঘর্ষের ঘটনায় ২৭ জনকে আটক করা হয়েছিল। মামলার পর তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় গ্রেফতার আসামীরা হলেন- সবুজ মোল্লা, মো. মনিরুজ্জামান, সবুজ, ইরাক শেখ, রিপন, মকবুল হোসেন, আক্তার হোসেন, শাওন মিয়া ও রাইসুল ইসলাম। এছাড়া মামলার এজাহারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি এ কে এম ফজলুল হক মিলন, কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মীর সরফত আলী সপু, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দীন অসীম, সাবেক ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারী, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, যুবদলের সদস্য আবুল খায়ের লিটনসহ ৪৬ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় করা মামলায় দলের ধানমন্ডি থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শাহদাত হোসেন সৈকতসহ ১২ জনের একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। একই মামলায় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলমসহ ১৫ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়।

রিমান্ডে যাওয়া অন্য আসামীরা হলেন- মো. সাইফুল ইসলাম, রিপন হোসেন, মো. রুহুল, মো. আব্দুস সালাম, মো. সুজন, মো. নজরুল ইসলাম, শফিকুর রহমান, রুবেল হোসেন, সাব্বির আহমেদ, আমিনুল ইসলাম ও শাহ আলম। কারাগারে যাওয়া আসামীরা হলেন- মো. জুয়েল, মজিবুর রহমান সানজু, মো. রুবেল হোসেন, মো. জিয়াউল ইসলাম, মো. জুয়েল, আমিন, ইব্রাহিম খলিল পারভেজ, সোহেল রানা, শিকদার হোসেন, মো. সিদ্দিক, মোহাম্মদ রাসেল, রুবেল, মোহাম্মদ শাহিন, তারেকুল ইসলাম। এদিন ২৭ আসামীকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ধানমন্ডি থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শাহদাত হোসেন সৈকতসহ ১২ জনকে তিনদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে বিচারক তাদের একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্যদিকে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলমসহ ১৫ জনকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করা হয়। অন্যদিকে সায়েন্সল্যাব এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় করা মামলায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ ১৬ নেতাকর্মীকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি চলাকালে হামলা-ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের কাজে বাধা, ইটপাটকেল ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিক্ষেপের অভিযোগে করা পৃথক দুই মামলায় আদালত তাদের ছয় সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন।

https://dailysangram.info/post/525708