২২ মে ২০২৩, সোমবার, ৩:৩২

প্রতিদিন গড়ে ৯ জনের বেশি খুন

দেশে গত এপ্রিল মাসে প্রতিদিন গড়ে ৯.২ জন করে খুন হয়েছে। এই মাসটিতে মোট ২৭৬ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে নারী ও কন্যাশিশু ছিল ৩৫ জন। গত বছরের এপ্রিল মাসে ২৬৭ জন হত্যার শিকার হয়।
গড়ে প্রতিদিন খুন হয় ৮.৯ জন।

রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরোধ, মাদক, পারিবারিক অশান্তি, আর্থিক দ্বন্দ্বসহ নানা বিষয়ে বিরোধের জেরে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞরা পারিবারিক শিক্ষা ও মেলবন্ধন জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। একই সঙ্গে সামাজিক নজরদারি বাড়াতে ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কমাতে পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

গত এপ্রিল মাসের ঘটনাগুলোর মধ্যে গুলিতে মারা গেছে ১৭ জন। গুলিবিদ্ধ হয়েছে অন্তত ৭৭ জন। অন্যদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছে ১৮৪ জন।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, গত এপ্রিলে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছে আটজন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, একই সময় নারী ও কন্যাশিশু খুন হয়েছে ৩৫ জন।

মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে গত ৩০ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। তারা বলেছে, এপ্রিলে বিভিন্ন জেলায় রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতায় আটজন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে তিনজন ক্ষমতাসীন দলের, একজন বিএনপিকর্মী, একজন মুদি দোকানদার, একজন টাইলস শ্রমিক ও দুজন সাধারণ নাগরিক।
আহতদের মধ্যে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন।

পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত মাসে কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি, ২৫ জন খুন হয়েছে। এরপর ঢাকায় খুন হয় ২১ জন। আর একজন করে খুন হয়েছে পিরোজপুর, বরগুনা, লালমনিরহাট, চাঁদপুর, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, পঞ্চগড়, পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও খাগড়াছড়িতে।
এ ছাড়া হবিগঞ্জে ১৪, কিশোরগঞ্জে ১১, নারায়ণগঞ্জে ১১, কুমিল্লায় ১০, সুনামগঞ্জে ১০, ময়মনসিংহ, বান্দরবান ও রংপুরে ৯ জন করে হত্যার শিকার হয়। বাকি জেলাগুলোয় গড়ে আট থেকে দুজন করে খুন হয়েছে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে। অর্থনীতি ঠিক করতে হবে। পারিবারিক বন্ধন আরো মজবুত করতে হবে। সমাজে যেসব কারণে মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সেসব জায়গা খুঁজে বের করে সমাধানের পথ বের করতে হবে।

আলোচিত গুলির ঘটনা : রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলায় গত ৩০ এপ্রিল রাতে মিজানুর রহমান নামের একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি স্থানীয় একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন।

পাংশা মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ঘটনায় এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৯ আসামির মধ্যে তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা চাঁদা চেয়ে না পেয়ে অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি করে ওই শিক্ষককে হত্যা করার কথা জানিয়েছেন।

একই রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন তিতাস উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেন। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, তিতাস উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম ওরফে সোহেল শিকদার তাঁর অনুসারীদের দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।

একই রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর পশ্চিম বাজার বাইতুন নুর জামে মসজিদ এলাকার সুমাইয়া কনফেকশনারির সামনে বোরকা পরা তিন দুর্বৃত্ত গুলি করে যুবলীগ নেতা জামাল হোসেনকে হত্যা করে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাজেশ বড়ুয়া বলেন, দলীয় কোন্দলের জের ধরে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

গত ২৫ এপ্রিল রাতে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম। নোমান লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে ছিলেন।

গত ২৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় নরসিংদীর রায়পুরার চরাঞ্চলে জুলহাস মিয়া নামের একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন আরো তিনজন।

৩ এপ্রিল রাতে রাজবাড়ী সদর উপজেলায় শেখ সুমন সবুজ নামের স্থানীয় ছাত্রলীগের এক নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি উপজেলার বরাট ইউনিয়নের উড়াকান্দা গ্রামের বাসিন্দা ও ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন।

অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, সারা দেশে নানা কারণে খুনাখুনি বেড়েছে। এর কয়েকটি কারণ হলো সামনের নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি, মাদকের ছড়াছড়ি, দিন দিন পারিবারিক মেলবন্ধন কমে যাওয়া, প্রযুক্তির অপব্যবহার, উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনুসারে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়া, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানো, স্বার্থ পরায়ণয়তা ও অর্থের লোভ বেড়ে যাওয়া।

ধারালো অস্ত্রে খুন : গত ২৫ এপ্রিল রাতে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় একটি দোকানে কাপড় কেনা নিয়ে বিরোধের জেরে সজল ও মামুন নামের দুই যুবককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২৩ এপ্রিল ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়নে মনিরা নামের এক নারীকে হত্যা করা হয়; ২৫ এপ্রিল কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার চককৃষ্ণপুর গ্রামে মাদকের টাকা নিয়ে বিরোধে মারুফ হোসেন নামের একজনকে হত্যা করা হয়; ৩০ এপ্রিল রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরে খুন হন কলেজছাত্র সিজার হোসেন।

সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘সামনে আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত নানা চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর যেকোনো চক্রান্ত নস্যাৎ করতে তাঁরা তৈরি আছেন।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/05/22/1282285