২২ মে ২০২৩, সোমবার, ৩:২৩

বিরোধীদলহীন সিটি নির্বাচনও ‘সুষ্ঠু’ হওয়া নিয়ে শঙ্কা

আগামী ২৫ মে গাজীপুর দিয়ে শুরু হচ্ছে পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কেমন হবে আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরশেন নির্বাচন। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সরকার বিরোধীরা এই নির্বাচন বয়কট করেছে। তাই পাঁচ সিটির নির্বাচন পরিণত হয়েছে একটি প্রতিদ্বন্ধিতাহীন একপেশে নির্বাচনে। একতরফা এই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে। বিশেষ করে সরকারি দলের প্রার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেয়া, স্বতন্ত্র বা অন্য প্রার্থীদের প্রচারণায় বাধা প্রদান, এসবে অনেকেই নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। যদিও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তবে রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, সরকারি দল বা ইসির এই ধরনের বক্তব্য ‘আইওয়াশ’ মাত্র। এর আগেও তারা এ ধরণের বক্তব্য দিয়েছিল। বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো। তারা বলছেন, এই সিটি নির্বাচনও একটি প্রহসনের নির্বাচনের পরিণত হবে। যা খোদ সরকারের আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক দল ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এছাড়া নির্বাচন নিয়ে এমন একটা অবস্থা হয়েছে তাদের (ক্ষমতাসীন জোট) যে জোট আছে ১৪ দল, সেই জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, যিনি সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি কিছুদিন আগে বলেছেন, পরিকল্পিত নির্বাচন চাই না।

উল্লেখ্য বাকি চার সিটির মধ্যে ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল, ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনের ভোট অনুষ্ঠিত হবে।
আর মাত্র তিনদিন বাকি গাজীপুর সিটি নির্বাচনের। এরই মধ্যে শুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। হাতি প্রতীকের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলামের অভিযোগ, নির্বাচনে এজেন্ট দিতে বাধা দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা। আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন জানান, সরকারি দলের আচরণে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোটারদের শঙ্কা দূর করতে সরকারকেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত হাতপাখা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ সংশয় ও শঙ্কা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর নেতাকর্মী ও হাতপাখার লোকেরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করার পরেও বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা জরিমানা ও প্রচার কাজে বাধার সৃষ্টি করছেন। প্রশাসন সরকারি দলের প্রার্থীকে সব দিক থেকে সহযোগিতা করছে। নির্বাচনী মাঠ সবার জন্য সমতল নয়। গাজী আতাউর রহমান বলেন, সরকার দলীয় প্রার্থী বিশাল গাড়ি বহর নিয়ে প্রচারণা চালালেও সে বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটগণ নীরব? এভাবে চলতে থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে আমরা মনে করি না।

সূত্র মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে হতে যাওয়া এ নির্বাচনকে নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরপর দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশে-বিদেশে নানা বিতর্কের জš§ দেওয়ায় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্ববর্তী নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিধান ফিরিয়ে আনার দাবিতে সরকারের বিরোধী দলগুলো যখন অনড় এবং দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ একাধিক রাষ্ট্র, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে দীর্ঘদিন ধরেই অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছে এবং যে ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে দেশটির টানাপোড়েন চলছে বলে মনে করা হয়, সেরকম একটি পরিস্থিতিতে যেসব সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার, স্থানীয় সরকার, মাঠ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকা-ের দিকে স্বভাবতই নানা পক্ষের চোখ থাকবে। এ কারণে এ নির্বাচনে সরকার হয়তো এমন স্ট্র্যাটেজি নিতে চায় বা নেবে, যাতে তারা দেশে ও বিদেশে একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে পারে। অনেকে মনে করেন, সেই বার্তার প্রথম সংকেত হলো তাদের দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন যেমনই হোক না কেন, নির্বাচন খুব বেশি প্রাণবন্ত বা উত্তেজনাপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ‘নীল নকশা‘র নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থাটাকে তারা (সরকার) বেমালুম ধবংস করে দিয়েছে। দেখেন...আজকে নির্বাচনের অবস্থা কেমন? এই যে মেয়র ইলেকশন হচ্ছে...বেশির ভাগ সিটি করপোরেশনে বিরোধী দল কোনো প্রার্থী দিচ্ছেন না। জনপ্রিয় মেয়ররা জনসভা করে বলেছেন, এই নির্বাচন কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না, নির্বাচনই হবে না। তারা ব্লু প্রিন্ট করে ফেলেছে। এই নির্বাচনে যাওয়ার অর্থই হয় না, এটা অর্থহীন হবে। আমি মনে করি, এই নির্বাচন অর্থহীন হবে এবং এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না। তিনি বলেন, নির্বাচন একটা টুল, দেখাবে নির্বাচন, নির্বাচন নির্বাচন দেখাবে। নির্বাচন কমিশন তারা কথা বলবে, নির্বাচন কমিশনের কমিশনাররা কথা বলবেন। নির্বাচন একটা দেখানোর চেষ্টা করবে কিন্তু তারা পুরো নির্বাচনটাকে তাদের মতো করে নিয়ে যাবে। এই কারণে আমরা পরিস্কার করে বলেছি, অত্যন্ত পরিস্কার, স্পষ্ট, দৃঢ় উচ্চারণ যে, এই সরকার থাকলে কোনো নির্বাচন হবে না। হাসিনা সরকার থাকলে কোনো নির্বাচন হবে না। একটা নিরপেক্ষ তত্ত্ব্বাধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন সিটি নির্ভাচনও যে সুষ্ঠু হিবে না সেটির প্রমাণ বারবার এই সরকার দিয়েছে। গত মার্চে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘দ্য ২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। শুধু যে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণহীন ও সুষ্ঠু হয়নি তা নয়, এ দুটি নির্বাচনের মধ্যবর্তী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি। বিশেষ করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি ও সমমনা দলগুলো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যেমন-ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। গত কয়েক বছরে এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের ফল পর্যালোচনা করলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। এতে মানুষ নির্বাচনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এছাড়া এসব নির্বাচনেও ভোট ডাকাতির অভিযোগ করেছে পরাজিত প্রার্থীরা।

জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যাবলি-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের সহায়তা প্রদান, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব রাজনৈতিক দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, নির্বাচনে অর্থশক্তি ও পেশিশক্তির ব্যবহার ও প্রভাব প্রতিরোধ, রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রের নিরপেক্ষতা, ভোটের সময় ভোটকেন্দ্রে অনুমোদিত সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশাধিকার, ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অবাধ সুযোগ প্রদান ইত্যাদি গত এক দশকে বহুলাংশে হারিয়ে গেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো ক্ষমতাসীন দল ও তাদের গুটিকয়েক সহযোগী দলের অংশগ্রহণে অথবা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে একসময়ের পঞ্চম বৃহৎ গণতন্ত্রের এ দেশটিতে গণতন্ত্র নির্বাসনে যাবে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে যা দরকার তা হলো একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হবেনা অভিযোগ দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন সিলেটের দুইবারের জনপ্রিয় মেয়র আরিফুল হক। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়ে গেছে। ইভিএম দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করায় কড়া সমালোচনা করে নগরবাসীকে এ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। নগরবাসীর উদ্দেশে আরিফ বলেন, আপনারাই বলুন তো এই মুহূর্তে সিলেটে কিংবা পুরো দেশে নির্বাচনি পরিবেশ আছে কি? নাই, নাই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন ইভিএম’কে না বলে দিয়েছে, বাংলাদেশের আপামর জনগণ যেখানে ইভিএম’কে না করছে, সেই জায়গায় সিলেটে তারা নিয়ে এসেছে ইভিএম। এটা কিসের ইঙ্গিত? এটা আরেকটি ভোট ডাকাতির ইঙ্গিত। আরিফুল হক বলেন, ভোট নিয়ে মানুষের আস্থা এমন তলানিতে পৌঁছে গিয়েছে যে, কোনো নির্বাচন হলেই মানুষ প্রথমেই সন্দেহ করে বলে, ভোট দিনের বেলায় দিতে পারবে নাকি আগের রাতেই শেষ হয়ে যাবে? ভোটাধিকার নিয়ে সাধারণ জনগণের মন থেকে আস্থা উঠে গেছে। এমনকি অনেক আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের নেতাও এখন ভোটের অবস্থা দেখে আড়ালে-আবডালে নিজেরাই লজ্জা পান।

https://dailysangram.info/post/525199