২২ মে ২০২৩, সোমবার, ৩:১৮

যানজট দুর্ঘটনা এবং সড়ক পথের পরিস্থিতি

আশিকুল হামিদ

কিছুদিন আগেও রিকশার নগরী হিসেবে রাজধানী ঢাকার বিশেষ পরিচিতি ছিলো যাকে পরিচিতির পরিবর্তে ‘দুর্নাম’ বলাই ভালো। তখন বলা হতো, প্রধানত রিকশার আধিক্যের কারণে ঢাকা শুধু যানজটে স্থবিরই হয়ে পড়ে না, সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তন তাই বলে যানজট পরিস্থিতির হয়নি, পরিবর্তন হয়েছে প্রধান কারণের। এতদিন যানজটের জন্য রিকশাকে দায়ী করা হতো, বিগত কয়েক বছরে রিকশার স্থান দখল করেছে মোটর সাইকেল।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ঢাকায় সড়কের সক্ষমতার চাইতে চারগুণ বেশি মোটর সাইকেল চলাচল করছে। ঢাকার পথে চলাচলকারী মোট যানবাহনের ৫১ শতাংশই মোটর সাইকেল এবং প্রতিদিন ৩৭০টির বেশি নতুন মোটর সাইকেল সড়কে নামছে। এসব মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানিরও কারণ হয়ে উঠছে। একই কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির জন্য এখন আর শুধু বাস ও ট্রাকের মতো যানবাহনকে দায়ী করা হয় না। পরিবর্তে বিগত কিছুদিন ধরে প্রাধান্যে এসেছে মোটর সাইকেল। বিভিন্ন্ জরিপে দেখা গেছে, নিকট অতীতের ধারাবাহিকতায় বিগত মাস এপ্রিলেও মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এই এক মাসে মারা গেছে ২৭৯ জন, যে সংখ্যা মোট নিহতদের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৫২ শতাংশ।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত তথ্য-পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার তৈরি করা রিপোর্টে জানানো হয়েছে, সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এই বিভাগে ১২৭টি দুর্ঘটনায় ১৫৯ জন মানুষ মারা গেছে।

পরিসংখ্যানে আরো জানানো হয়েছে, রাজধানী ঢাকায় এপ্রিল মাসে ২৩টি দুর্ঘটনায় ২৬ জন মারা গেছে। গবেষণা সংস্থাটি জানিয়েছে, ওই এক মাসে প্রতিদিন গড়ে ২০ দশমিক ৬৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে। উল্লেখ্য, আগের মাস মার্চেও প্রতিদিন গড়ে মারা গিয়েছিল ১৮ জন। সে হিসাবে এপ্রিল মাসে নিহতদের সংখ্যা বেড়েছে ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ।

উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশেষ করে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা আরো বলেছেন, দরকার যখন গণপরিবহনকে সহজ, সাশ্রয়ী ও উন্নত করে যানজট কমানোর পাশাপাশি মোটর সাইকেলকে নিরুৎসাহিত করা এবং এর সংখ্যা কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া, সরকার তখন এমন সব ব্যবস্থ্া নিচ্ছে, যেসবের ফলে মোটর সাইকেলের সংখ্যা উল্টো দ্রুত বেড়ে চলেছে। উদ্বেগের কারণ হলো, শুধু মোটর সাইকেলের সংখ্যাই বাড়ছে না, পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর সংখ্যাও।

উদাহরণ দিতে গিয়ে এক সাম্প্রতিক গবেষণায় জানানো হয়েছে, ২০২১-২২ এবং ২০২৩ সালে মোটর সাইকেলের কারণে ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিউটের এক রিপোর্টে জানা গেছে, পাঁচ বছর আগের তুলনায় ২০২২ সালে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ২২৬ শতাংশ। বছরভিত্তিক পরিসংখ্যানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রতি বছর মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার সঙ্গে আশংকাজনকভাবে নিহতদের সংখ্যাও বেড়েছে। এসব দুর্ঘটনায় নানাভাবে আহত ও পঙ্গুও হচ্ছে অনেকে। এমন অবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তথ্যাভিজ্ঞ বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, প্রাইভেট কার বা গাড়ির তুলনায় দাম অনেক কম হওয়ায় বিশেষ করে তরুণ-যুবকদের মধ্যে মোটর সাইকেলের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা বেশি। মোটর সাইকেল কেনার জন্য আয়কর ধরনের কোনো কাগজপত্রও দেখাতে হয় না। যে কেউ দোকানে গিয়ে দামাদামি করে মোটর সাইকেল কিনতে এবং চালাতে পারে। গাড়ির চালকদের মতো কোনো পরীক্ষা দিতে হয় না বলে কোনোভাবে চালানো শিখেই তরুণ-যুবকরা তাদের বাহন নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। বাস্তবে এভাবেই মোটর সাইকেলের সংখ্যা লাফিয়ে বেড়ে চলেছে।

বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় জানা গেছে, মোটর সাইকেলের ব্যাপারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষÑ বিআরটিএ জানিয়েছে, দেশে নিবন্ধিত মোটর সাইকেলের সংখ্যা মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। এসবের বাইরে বড় একটি অংশ নিবন্ধন ছাড়াই রাস্তায় চলাচল করছে। ওদিকে বিপণনকারী কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ নতুন মোটর সাইকেল বিক্রি হয়ে থাকে এবং সেগুলো দু’-চারদিনের মধ্যেই সড়কে চলাচল শুরু করে। দুর্ঘটনাও এসব মোটর সাইকেলই বেশি ঘটিয়ে থাকে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, মোটর সাইকেলের ব্যাপারে সরকারের উচিত জরুরিভিত্তিতে তৎপর হয়ে ওঠা। কারণ, সকল জরিপেই প্রমাণিত হয়েছে, অন্তত ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হলেও মোটর সাইকেলের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমন অবস্থার অবশ্যই অবসান ঘটানো দরকার।

উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা মোটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, সরকারকে অবশ্যই এমন সুচিন্তিত ব্যবস্থা নিতে হবে, যার ফলে একদিকে মোটর সাইকেলের সংখ্যা কমে আসবে এবং অন্যদিকে চালকরা আইন মেনে চলতে বাধ্য হবেন।

আমরা মনে করি, রাজধানীতে মোটর সাইকেল পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপদজনক অবস্থায় পৌঁছে গেছে। গণমাধ্যমের রিপোর্ট লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শত শত গাড়ির ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাসহ সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের বিবরণই শুধু থাকে না, থাকে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির কথাও। বিষয়টি নিয়ে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনাও কম হয়নি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে না কোনো পরিকল্পা নেয়া হয়েছে, না নেয়া হয়েছে সমাধানের সুষ্ঠু কোনো পদক্ষেপ। ফলে মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগ অব্যাহত থেকেছে এবং এখনও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থা সময়ে সময়ে পরিস্থিতির পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। যেমন কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা এক গবেষণা রিপোর্টে জানিয়েছেন, তীব্র যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন মানুষের ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। অর্থের দিক থেকে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮৪ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়েছিল, যানজটের ফলে রাজধানীতে গাড়ির গতি অনেক কমে গেছে। ১০ বছর আগেও ঢাকায় একটি যানবাহন ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারতো। এখন সে একই যানবাহনের গতি ঘণ্টায় ছয় দশমিক দুই কিলামিটারে এসে নেমেছে। অথচ একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে পারে। সেদিক থেকে যানবাহনের গতি মানুষের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছিলেন, অবস্থায় পরিবর্তন না ঘটানো গেলে মাত্র দু’বছর পর, ২০২৫ সালে যানবাহনের গতি আরো কমে ঘণ্টায় মাত্র চার কিলোমিটারে নেমে আসবে। তখন মানুষ হেঁটেই যে কোনো যানবাহনের চাইতে কম সময়ে বেশি দূরে যাতায়াত করতে পারবে।

উদ্বেগের কারণ হলো, সব জেনে-বুঝেও সরকার ব্যস্ত রয়েছে ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলের মতো অপরিকল্পিত এমন কিছু বিষয় ও সেগুলোর নির্মাণ কাজ নিয়ে, যেগুলোর জন্য হাজার কোটির অংকে টাকা ব্যয় করা হলেও যানজট নিরসনের কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমরা আশা করতে চাই, সরকার দেশপ্রেমিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে এমনভাবে সড়ক নির্মাণ করবে যাতে একদিকে যানজট সমস্যার সমাধান হবে এবং অন্যদিকে রাজপথে যানবাহনের গতি বাড়বে কয়েকগুণ পর্যন্ত।

https://dailysangram.info/post/525155