২৩ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৯:২১

অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বাজেট ঘাটতি

লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা বেশি * রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অতি উচ্চাভিলাষী। তাই অর্জন সম্ভব হচ্ছে না - ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেেেছ চলতি অর্থবছরের (২০১৬-১৭) বাজেট ঘাটতির পরিমাণ। গত ৫ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) পাঁচ শতাংশ অতিক্রম করেছে এ ঘাটতি। বাজেট রীতি অনুযায়ী এর পরিমাণ পাঁচ শতাংশের মধ্যে থাকার কথা। রাজস্ব আদায়ে শ্লথ গতির কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।


অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বাজেটে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধিত বাজেটে তা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা বেশি (জিডিপির ৫ দশমিক ৪ শতাংশ)।

এর আগে পাঁচ শতাংশ করে ঘাটতি ছিল ২০১৫-১৬ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে। আর ২০১৩-১৪ এবং ২০১২-১৩ বছরে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল যথক্রমে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ও ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

আগামী অর্থবছরেও (২০১৭-১৮) এ বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ অতিক্রম করবে বলে আভাস দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বাজেট) হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, চলতি বাজেটে রাজস্ব আয় কমবে। কারণ এনবিআর রাজস্ব, এনবিআরবহির্ভূত রাজস্ব ও এনটিআরের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আয় কমার পাশাপাশি ব্যয়ের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকলে, বাজেট ঘাটতি বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সংশোধিত বাজেটের মূল আকার কমছে। এরপরও ঘাটতি পরিমাণ বেশি দেখানো হচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অতি উচ্চাভিলাষী, আগেও বলেছি। ফলে তা অর্জন সম্ভব হবে না।

সূত্রমতে, চলতি বাজেটের মোট আকার হচ্ছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেট হচ্ছে ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। ঘাটতি পূরণ করতে বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয় সরকার।

সূত্রমতে, ঘাটতি বাজেট নিয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সম্পদ কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়। নতুন ভাবে ঘাটতি অর্থায়ন পূরণ করতে সেখানে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ঘাটতি পূরণ যেভাবে-

বিদেশ থেকে ঋণ : চলতি বাজেটে ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩৮ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে তা কাটছাঁট করে ২৮ হাজার ৭৭০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ওই হিসাবে বিদেশ থেকে ঋণ পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয় ১০ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদেশ থেকে এ বছর চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাওয়ায় যায়নি। ফলে সরকার ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে।

অভ্যন্তরীণ ঋণ : ঘাটতি অর্থায়নের জন্য একটি উৎস হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ঋণ। এ বছর এ ঋণের লক্ষ্য ধরা হয় ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। কিন্তু বিদেশি ঋণ পর্যাপ্ত না পাওয়ায় চাপ বেড়ে যায় অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর। ফলে সংশোধিত বাজেটে এ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করে ৭৭ হাজার ৯শ’ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সরকার ১৬ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা বেশি ঋণ গ্রহণ করতে যাচ্ছে।

জানা গেছে, ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণ নেয়া হয় মূলত তিনটি খাত থেকে। এর মধ্যে ব্যাংকিং, ব্যাংকবহির্ভূত এবং সঞ্চয়পত্র খাত রয়েছে। ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এ তিন খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে।

ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ : ২০১৬-১৭ অর্থবছর বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এটি জিডিপির ২ শতাংশ। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন করে এ লক্ষ্যমাত্রা ৪০ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এ বছর সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এখন পর্যন্ত কম গ্রহণ করছে।

ব্যাংকবহির্ভূত খাত : ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ২২ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৩৭ হাজার ৯শ’ কোটি টাকা নির্ধারণ হয়। ফলে এ খাত থেকে ১৫ হাজার ২৯০ কোটি টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে।

সঞ্চয়পত্র : ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে এ খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুণ করা হয়। সর্বশেষ হিসাবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার এ খাত থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। তবে বেশি পরিমাণ এ খাত থেকে ঋণ নেয়া বাজেটের ওপর সুদ পরিশোধের চাপও বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

http://www.jugantor.com/last-page/2017/04/23/119449/