২১ মে ২০২৩, রবিবার, ৪:৫৬

আগামী বাজেটে ব্যাংক থেকে ২৮ শতাংশ বেশি ঋণ নেবে সরকার

ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ব্যাপক হারে ঋণ নিচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৬৭ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১ টাকা বাজারে ছাড়লে তা ৫ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ফলে বাজারে নোটের পরিমাণ বেড়ে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫৩০ কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে। জনগণের হাতে অতিরিক্ত অর্থ থাকলে পণ্যের চাহিদা তৈরি হবে যা দাম বৃদ্ধি করবে। আগামী অর্থবছর বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে চলতি অর্থবছরের লক্ষমাত্রার তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি ঋণ নেবে সরকার। এতে পণ্যের দামে লাগাম টানা হবে দুঃস্বাধ্য।

জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি কমানোর জন্য ব্যাংকিং খাতের উপর আরো বেশি নির্ভর করতে যাচ্ছে সরকার। বিশ্লেষকদের ধারণা, এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ কমে যাবে; পরিণামে বিনিয়োগের বৃদ্ধি ধীরগতির হয়ে যেতে পারে। আগামী বাজেটে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি ব্যাংকিং খাত থেকে পূরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছর বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি ঋণ নেবে সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে ১,০৬,৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। শুধু এপ্রিল মাসেই সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ২৯,৬৯৬ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে কোনো মাসে ব্যাংক থেকে নেওয়া সর্বোচ্চ ঋণ। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পাবলিক প্রকিউরমেন্টের জন্য তহবিলের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সরকারকে ব্যাংক ঋণ বাড়াতে হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আনুমানিক বাজেট ঘাটতি মোট জিডিপির ৫.২ শতাংশ এবং আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) মোট বরাদ্দের সমান।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, জিডিপির অনুপাতে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মনে হলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ যে হারে বাড়ছে, তাতে এত বেশি ঘাটতির বাজেট কাম্য নয়। তাছাড়া, অপচয় কমাতে পারলে এতো বেশি ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হতো না। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোতে এখন তারল্য সংকট চলছে। এমন পরিস্থিতিতে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। ব্যবসায়ীদের যখন ঋণ দরকার, তখন সরকার ব্যাংক থেকে আরও বেশি ঋণ নিলে বেসরকারিখাতে ঋণের প্রবাহ কমে যাবে।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১০ মে পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৬৭ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আগের অর্থবছরে সরকার নিয়েছিল ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষ ২ মাসে ঋণের পরিমাণ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ সরকারকে উন্নয়ন ও রাজস্ব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাজারে টাকা ছাড়ার ফলে নোটের পরিমাণ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১ টাকা বাজারে ছাড়লে তা ৫ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, ফলে সরকার যে ৬৭ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, শেষ পর্যন্ত এর পরিমাণ বেড়ে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫৩০ কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে। জনগণের হাতে অতিরিক্ত অর্থ থাকলে পণ্যের চাহিদা তৈরি হবে যা দাম বৃদ্ধি করবে। বিপুল পরিমাণ অর্থ বাজারে ছাড়লে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অর্থের প্রচলন বেড়ে গেলে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বেড়ে যায়, যার ফলে আমদানিও বাড়বে। আমদানি বৃদ্ধির অর্থ হলো রিজার্ভ আরও চাপের সম্মুখীন হবে। গত বছরের মে মাসে রিজার্ভ ছিল ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। তা ২৮ শতাংশ কমে গত সপ্তাহে ৩০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদেশি উৎস থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে। এটি চলতি অর্থবছরের লক্ষমাত্রার তুলনায় মাত্র ৪,৫০০ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছর বিদেশি উৎস থেকে ৯৫,৪৫৮ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

অর্থবছরের শেষ দিকে এসে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে। জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে নিয়েছে ৮২ হাজার ৫৬ কোটি টাকা, যা বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৭৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। অন্য উৎস থেকে না পেয়ে নগদ অর্থের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিপরীতেই বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই-এপ্রিল সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিট ঋণ নিয়েছে ৭৪ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৭ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। এ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বেড়েছে এক বছরে ৬৭ হাজার ২৩০ কোটি টাকা বা ৯৩৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ নিয়ে গত এপ্রিল শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সরকারের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা।
আর গত এপ্রিল শেষে সরকারের ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা, এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকেরই ২ লাখ ২১ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে যা ছিল ৩ লাখ ২ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা এবং ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ২ লাখ ২১ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা।

অর্থ বিভাগ বলছে, বর্তমানে ইনভেস্টমেন্ট রেটের তুলনায় সেভিংস রেট বেশ কম। এমন অবস্থায় সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে আগামী অর্থবছর বেসরকারিখাতের বিনিয়োগে যে ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সরকার আশা করছে, তা পূরণ না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঘাটতি অর্থায়নের পরিবর্তে বিদেশি উৎস থেকে কম সুদের অর্থায়ন বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।

https://dailysangram.info/post/525101