২০ মে ২০২৩, শনিবার, ১২:২৬

ঝুঁকিতে পড়বে রফতানি

‘বিপদে যে পাশে দাঁড়ায় সেই তো প্রকৃত বন্ধু’ নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাটকের এই ডায়লগ কমবেশি সবার জানা। বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে প্রমাণ হয়েছে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু কোন দেশ। করোনাকালে অগ্রিম টাকা নিয়েও বাংলাদেশকে টিকা দেয়নি ভারত। চীন কিছু টিকা বাংলাদেশকে উপহার দিলেও বাংলাদেশে টিকা বিক্রি করে শত শত কোটি ডলার আয় করেছে। ব্যতিক্রম ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। প্রায় ১১ কোটি টিকা বাংলাদেশের জনগণকে উপহার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। করোনাকালের এই চিত্রই শুধু নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে একই চিত্র দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র দেশ যারা বাংলাদেশ থেকে ক্রয় করে বেশি; বিক্রি করে কম।

ভারত ও চীন থেকে প্রতিবছর আমরা বিপুল পরিামাণ টাকার পণ্য আমদানি করছি; অথচ দেশ দুটি বাংলাদেশের পণ্য কিনছে সামান্যই। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করছি; রফতানি করছি তার সাড়ে তিনগুন বেশি টাকার পণ্য। বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের ১৯ শতাংশ রফতানি করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পে যে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে তার পেছনেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘তৈরি পোশাক’ ক্রয়ের অবদান রয়েছে। ভিয়েতনাম ও শ্রীলংকার মতো দেশের তৈরি পোশাক ক্রয় কমিয়ে বাদ দিয়ে ওই সব দেশ বাংলাদেশ থেকে এই বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক ক্রয় করায় গার্মেন্টস সেক্টর ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে ‘যারা বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেসব দেশ থেকে কোনোরকম কেনাকাটা করবে না বাংলাদেশ’ এমন একটি বক্তব্যের পর সেই গার্মেন্টস সেক্টরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। গার্মেন্টস সেক্টর ব্যবসায়ী, শ্রমিক-কর্মচারীরা বলছেন, এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করায় দেশের গার্মেন্টসের ক্ষতি হয়েছে। সামনে যদি রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে দেশটি তৈরি পোশাক ক্রয় কমিয়ে দেয় তাহলে গার্মেন্টস শিল্প ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। কারণ এখন ভিয়েতনামসহ অনেক দেশ তৈরি পোশাকে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেসব দেশ থেকে কোনোরকম কেনাকাটা করবে না বাংলাদেশ।’ তিনি এই বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনাও দিয়েছেন বলে জানান। প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনা বাংলাদেশের আমদানি-রফতানিতে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে কি-না তা নিয়ে ব্যবসায়ী-অর্থনীতিবিদের মধ্যে আলোচনা চলছে। তাদের আশঙ্কা প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে না পড়লেও দেশের রফতানি পণ্যের বড় বাজার যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র, তাই সেদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলে রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

জানতে চাইলে সিরডাপের পরিচালক অর্থনীতিবিদ মো. হেলাল উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, যারা স্যাংশন দিয়েছে তাদের সঙ্গে লেনদেন না করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য রাজনৈতিক। কারণ আমাদের সাংশন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে লেনদেন না করে থাকা সম্ভব নয়। একক দেশ হিসেবে আমরা তৈরি পোশাক সবচেয়ে বেশি রফতানি করছি যুক্তরাষ্ট্রে। ডলার সংকটে আমরা আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক থেকে যে সফট লোন নিচ্ছি তার জন্যও তো যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন। কারণ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের পেছনের কলকাঠি তো যুক্তরাষ্ট্রেরই হাতে। প্রধানমন্ত্রী এইসব কথা বলে কিছুটা রাজনৈতিক দরকষাকষি করতে চান। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সব সম্পর্ক আছে কেনাকাটার সম্পর্ক থাকবে না- এটা অসম্ভব চিন্তা।

প্রধানমন্ত্রী ‘রাজনৈতিক’ বক্তব্য দিলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বুঝে না বুঝেই সেই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করছেন। আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তো আরো একধাপ এগিয়ে বলছেন, ‘আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনকে ভয় পাই না’।

বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো ডলার আর গার্মেন্টস পণ্য রফতানি থেকে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা। প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশে ভালো নেই, তাই আগের মতো রেমিট্যান্স আসছে না। আর গার্মেন্টস পল্লিগুলোতে শুরু হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান করেছে গার্মেন্টস সেক্টর। এখন তাদের মধ্যে আশঙ্কা বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গার্মেন্টস পণ্য আমদানি কমিয়ে দেয় কিনা। শিশু শ্রমিক এবং গার্মেন্টস কর্মীদের সংগঠন করার অধিকার না থাকার অভিযোগ তুলে দেশটি আগেই জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে। বছরের পর বছর ধরে অনেক দেন-দরবার করেও জিএসপি সুবিদা পুনর্বহাল করা যায়নি। এখন গার্মেন্টস পণ্য ক্রয় বন্ধ করে দিলে উদীয়মান সেক্টরটি মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে। গ্রামগঞ্জ থেকে আসা লাখ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বেন। বিশেষ করে মহিলা শ্রমিকরা হয়ে পড়বেন দিশাহীন। কারণ গার্মেন্টস পণ্য যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপের দেশগুলোতে রফতানি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে পথে হাঁটে ইইউ সে পথেই যান এটা সর্বজনবিদিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এমনিতেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে অসন্তুষ্টু। বিশেষ করে জনগণের ভোটের অধিকার না থাকায় দেশটি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উপর সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, গত ১০ এপ্রিল ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে ডেকে নিয়ে সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিকেন জানিয়ে দিয়েছেন তারা বাংলাদেশে বিশ্বমানের নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে মুখিয়ে রয়েছেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা পৃথিবী বাংলাদেশে নিরপেক্ষ এবং মডেল নির্বাচন দেখতে মুখিয়ে রয়েছেন। ফলে যদি আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা না যায়; তাহলে দেশটি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যদিও গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিদেশি কূটনীতিকদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘আমি আপনাদের (বিদেশি কূটনীতিক) আশ্বস্ত করতে চাই, আমার দেশে অবাধ, সুষ্ঠু, পক্ষপাতহীন এবং অংশগ্রহণমূলক একটা ঐতিহাসিক নির্বাচন হবে। আপনাদের কারও এ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।’ ওবায়দুল কাদের সত্যিই নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক নির্বাচন করতে চান নাকি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো ঐতিহাসিক নির্বাচন করতে চান তা খোলাসা করে বলেননি। কারণ দেশ-বিদেশের মানুষ মনে করে ২০২৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন এক দিক দিয়ে ‘ঐতিহাসিক’ বটে। কারণ ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ আসন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। আর ২০১৮ সালের নির্বাচন তো আগের রাতেই হয়ে গেছে।

গ্লোবালাইজেশনের যুগে সবাই সরার বন্ধু। কিন্তু বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র. চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য কেমন বন্ধু? এসব দেশের বাণিজ্যের দিকে তাকালে বন্ধুত্বের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের বাণিজ্যের চিত্রটা কেমন? দেখা যায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঘাটতি ব্যপক। দেশ দু’টি বাংলাদেশে পণ্য রফতানি করে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে যায়। বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে ক্রয় করে সামান্য পণ্য। ভারতের সঙ্গে ব্যবসার চিত্রে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ২০০ কোটি ডলারের কম ডলারের পণ্য ভারতে রফতানি করেন। তার বিপরীতে ভারত থেকে আমদানি হয় ১ হাজার ৬১৯ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৪২০ কোটি ডলারের মতো। একই চিত্র চীনের সঙ্গেও। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবির) তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে চীন থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির অর্থমূল্য ছিল ৯৯৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। একই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানি হওয়া পণ্যের অর্থমূল্য মাত্র ৩২ কোটি ৬০ লাখ ৮৫ হাজার ৬২০ ডলার। আবার চীনা শুল্ক কর্তৃপক্ষ জিএসিপিআরসির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য হয়েছে ১ হাজার ৪৩০ কোটি ২৪ লাখ ৯৭ হাজার ১৩২ ডলারের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির তথ্যের সঙ্গে চীনা শুল্ক কর্তৃপক্ষের বাণিজ্য পরিসংখ্যানে পার্থক্য ৪০১ কোটি ২০ লাখ ১১ হাজার ৫১২ ডলারের।

অথচ অন্য দিকে দেখা যায়, বাংলাদেশের পণ্য প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি বাড়ছে, অথচ ওই দেশ থেকে বাংলাদেশে আমদানি কম। ফলে বাণিজ্য পরিস্থিতি বাংলাদেশে অনুকূলে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৮৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে; যা দেশের মোট আমদানির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়েছে ৭৪০ কোটি ডলারের পণ্য। এটা দেশের মোট রফতানি আয়ের ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ওয়েবসাইট সেনসাস-এর তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে কিনেছে মোট ১১.১৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আর এবং বাংলাদেশে বিক্রি করেছে মাত্র ২.৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত সেদেশ থেকে বাংলাদেশে রফতানি হয়েছে ২.৪০ বিলিয়ন, আর একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হয়েছে ৫৯৫ বিলিয়ন। ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে আমদানি ছিল ৮.২৯৯ বিলিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রফতানি ছিল ২.৩৫ বিলিয়ন।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, একমাত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র তারা বাংলাদেশ থেকে বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে; বিপরীতে বাংলাদেশে তারা খুব কম পণ্য রফতানি করে। অন্যদিকে ভারত ও চীন বাংলাদেশে পণ্য বেশি রফতানি করে; বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে দেশ দু’টি সামান্য পণ্যই আমদানি করে থাকে।

https://dailyinqilab.com/national/article/575440