কার্টুন : শিশির
২৩ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৯:১৯

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা

মেয়র আসে যায়, দুর্ভোগ থেকে যায়

জলাবদ্ধতার কারণে গত শুক্রবার দুপুরে ঘর থেকে বের হতে পারেননি চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মী শাহরিয়ার খালেদ। রাতে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন, ‘নদীর নাম চাটগাঁ শহর, পানি উইট্টে এক কোঁয়র’ (নদীর নাম চট্টগ্রাম শহর, পানি উঠেছে এক কোমর)।

থইথই পানিতে ডুবে যাওয়া শহরের দৃশ্য টেলিভিশনে দেখে আরেকজন তো কক্সবাজার থেকে সাঁতার কাটতে চট্টগ্রামে ছুটে আসতে চেয়েছিলেন। আয়াজ মাবুদ নামের ওই ব্যক্তি শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁর ফেসবুক পাতায় লেখেন, ‘অনেক দিন সাঁতার কাটি না। সে আশা পূরণের লক্ষ্যে চট্টগ্রামের পথে।’
প্রতিবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় মেয়র প্রার্থীদের প্রধান প্রতিশ্রুতিই থাকে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন। গত ১০ বছরে ভোটের মাধ্যমে চট্টগ্রামের মেয়র বদল হয়েছে তিনবার। কিন্তু জলাবদ্ধতার সমস্যা একটুও বদলায়নি। ফলে মানুষের দুর্ভোগও কমেনি।
চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল জলাবদ্ধতা নিরসন। নির্বাচনী ইশতেহার ‘জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে এই সমস্যাকে সমাধানযোগ্য বলে উল্লেখ করেন তিনি। ইশতেহারে লেখা ছিল, ‘১৯৯৫ সালের নগর মহাপরিকল্পনার সময়োপযোগী নবায়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব।’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সমস্যার সমাধান হয়নি।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল মেয়র নির্বাচিত হন আ জ ম নাছির। দুই বছর পর আবার এই এপ্রিল মাসেই দুবার (৪ ও ২১ এপ্রিল) পানিতে তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম। অচল হয়ে পড়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই যেদিন মেয়রের দায়িত্ব নেন তিনি, সেদিনও জলাবদ্ধ ছিল চট্টগ্রাম নগরের একাংশ।
এখন একটু ভারী বৃষ্টি হলেই নগরের দুই নম্বর গেট, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, প্রবর্তক মোড়, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, বাকলিয়া, আগ্রাবাদ এলাকা তলিয়ে যায়। বছরের পর বছর এই অবস্থা চলে আসছে। গত শুক্রবারের জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হন নগরের চকবাজারের কাঁচাবাজার এলাকার সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ জাহেদ। গতকাল শনিবার দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টির পানিতে তাঁর দোকানের আলু, পটোল, বেগুন, কাঁকরোলসহ বিভিন্ন তরিতরকারি ভেসে গেছে। ২০ হাজার টাকার পণ্যের মধ্যে ৬ হাজার টাকার পণ্যই পানিতে ভেসে গেছে।
সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে নগরের খাল, নালা-নর্দমা থেকে মাটি উত্তোলন বাবদ করপোরেশনের ব্যয় হয় ২১ কোটি ২৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। গত অর্থবছরে নগরের পানিনিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম চাক্তাই খাল থেকে মাটি তোলায় খরচ পড়ে ৪ কোটি ৬ লাখ টাকা।
চলতি বছরও নগরের বিভিন্ন খাল ও নালা-নর্দমা থেকে মাটি উত্তোলনের কাজ শুরু করেছে সিটি করপোরেশন। এবার ১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৮৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেছেন মেয়র নাছির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ হিসেবে খাল ও নালা-নর্দমাগুলো নিয়মিত খনন এবং নতুন নতুন নালা নির্মাণ ও বিদ্যমান নালাগুলো প্রশস্ত করা হচ্ছে। যাতে এই দুর্ভোগ সহনীয় রাখা যায়। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি উপায় হিসেবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাব পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চট্টগ্রাম ওয়াসার ‘চট্টগ্রামের পানি সরবরাহ উন্নীতকরণ ও স্যানিটেশন’ প্রকল্পের আওতায় ড্রেনেজ ও সুয়ারেজ মহাপরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
জলাবদ্ধতায় প্রতিবছরই ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির শিকার হন ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। বর্ষা মৌসুম ছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এই এলাকায়। গত বছরের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন দোকান-গুদামে পানি ঢোকে। এতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা।
চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে পণ্য নষ্ট হবে—এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।
১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) প্রণীত মহাপরিকল্পনায় জলাবদ্ধতা নিরসনে তিনটি নতুন খাল খনন এবং বিদ্যমান খাল সংস্কারের বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশনগুলো এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করে খাল ও নালা-নর্দমা থেকে মাটি উত্তোলন এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যস্ত থেকেছে। এ জন্য গত ১৩ বছরে ব্যয় হয়েছে ২৯২ কোটি টাকা।
প্রতিবছর জলাবদ্ধতা দূর করতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন গড়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ করে। এরপরও নগরের জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে কেন মুক্তি মেলে না জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত বলেন, নালা-নদর্মা থেকে মাটি তুলেই বেশির ভাগ টাকা খরচ করে করপোরেশন। এভাবে কোনো দিন এ সমস্যা দূর হবে না। শহরের কোন এলাকায় কী কারণে জলাবদ্ধতা হচ্ছে, আগে তা খুঁজে বের করা দরকার। এরপর কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, নগরের অধিকাংশ খাল দখল হয়ে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব দখলদার উচ্ছেদে সাহসী ভূমিকা দেখাতে পারছে না সিটি করপোরেশন।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1154721/