২০ মে ২০২৩, শনিবার, ১২:২২

দুর্ঘটনা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ হবে

ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে গত ১৯ মার্চ বাস দুর্ঘটনায় ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছিল, বাসটির ফিটনেস সনদ ছিল না। কারণ সেটি সড়কে চলার উপযোগী ছিল না।

চলাচল অনুপযোগী, অচল ঘোষিত বা আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া মোটরযান বিনষ্ট করে ফেলতে একটি নীতিমালা করছে সরকার। এই মোটরযান স্ক্র্যাপ নীতিমালা-২০২৩ অনুমোদন শেষে বাস্তবায়ন করা গেলে পরিবহন দুর্ঘটনা ও যানবাহনের দূষণ কমানো সম্ভব হবে। এই নীতিমালার খসড়া এরই মধ্যে মতামতের জন্য প্রকাশ করা হয়েছিল। গত বুধবার সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ওয়েবসাইটে নীতিমালার খসড়াটি দেওয়া হয়। পরদিন খসড়াটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন লেখার সময় খসড়াটি পাওয়া যায়নি।

ওই দিন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, কিছু সংযোজন করার জন্য নীতিমালার খসড়া কপি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সংযোজন শেষে আবার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। গতকাল শুক্রবারও খসড়াটি ওয়েবসাইটে ছিল না।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো অতি পুরনো ও চলাচলের অনুপযোগী (আনফিট) গাড়িগুলোকেই বেশির ভাগ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে আসছে। যদিও প্রতিবছর সড়কে কী পরিমাণ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, তার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই।

স্ক্র্যাপ নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, মেয়াদ শেষ হওয়া মোটরযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ না থাকায় এসব মোটরযান সড়কে চলাচল করছে। এতে সড়ক নিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে, পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি ধ্বংস করলে যেমন সড়ক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বাড়বে, তেমনি পরিবেশদূষণ হ্রাস পাবে।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা কত তা হিসাব না করে বলা কঠিন। তবে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বসে আমরা গাড়ির মেয়াদ ঠিক করেছি, যা বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে ২০ বছর এবং ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের ক্ষেত্রে ২৫ বছর ও অটোরিকশার জন্য ১৫ বছর।

তবে স্ক্র্যাপ নীতিমালার খসড়ায় গাড়ির মেয়াদের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। সব পক্ষের মতামত নিয়ে নীতিমালা চূড়ান্ত করার সময় তা যুক্ত করা হবে। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ৩৬ ধারায় মোটরযানের মেয়াদ নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা আছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমীন উল্লাহ নুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নীতিমালা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এটি শুধু খসড়া প্রস্তাব। মতামতের ভিত্তিতে এখানে অনেক কিছু পরিবর্তন করা হবে। চূড়ান্ত নীতিমালায় মেয়াদসহ সব কিছু স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে।’

কবে নাগাদ চূড়ান্ত নীতিমালা প্রকাশ করা হবে, জানতে চাইলে আমীন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘বিষয়টি এখন আপনাদের হাতে। ওয়েবসাইট ও ই-মেইলের মাধ্যমে মতামত নেওয়া হচ্ছে। খসড়ার মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়াটা শুরু হলো। ধারাবাহিকভাবে বাকি কাজ শেষ হওয়ার পর নীতিমালা চূড়ান্ত হবে।’

মোটরযানে স্ক্র্যাপ কী : বিআরটিএ আইন বলছে, মোটরযান স্ক্র্যাপ মানে মোটরযান থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশ আলাদা করার পর বিনষ্ট বা ধ্বংস করা। সড়ক পরিবহন আইনের মাধ্যমে গাড়ির মেয়াদ নির্ধারণ করা হবে। বিআরটিএর মাধ্যমে মোটরযান স্ক্র্যাপ করার জন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হবে, যাদের স্ক্র্যাপ ভেন্ডর বলা হবে।

আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মোটরযান অকেজো ঘোষণা ও নিষ্পত্তির নীতিমালা অনুযায়ী অকেজো ঘোষিত মোটরযান, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালা বা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অকেজো যানবাহন এবং সড়কে চলাচল অযোগ্য ব্যক্তি মালিকানাধীন যেকোনো মোটরযান হতে পারে।

বিআরটিএর নিবন্ধিত মোটরযানের তালিকায় দেখা যায়, গত এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোটরযান রয়েছে ৫৭ লাখ ১০ হাজার ৮৩৬টি। ২০১০ সাল থেকে গত মাস পর্যন্ত সময়ে নিবন্ধন পেয়েছে ৫৫ লাখ ৮৭ হাজার ৮৩৬টি মোটরযান। বাকি এক লাখ ২৩ হাজার মোটরযান এর আগে নিবন্ধন পাওয়া।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু মেয়াদ দিয়েই একটি গাড়ি আর চলার উপযোগী না বলে নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। গাড়ির মান কেমন আছে, সেখানেও জোর দেওয়া যেতে পারে। সঙ্গে মাইলেজ নির্ধারণ করা যেতে পারে। কোনো গাড়ি যদি বেশি চলে, তাহলে সেটা কম সময়েও খারাপ হতে পারে।’

দুর্ঘটনা ও দূষণ কমবে : আনফিট গাড়ির কারণে প্রতিবছর সড়কে কী পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটে, সেটার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।

সড়কে দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান কালের কণ্ঠ’র কাছে দাবি করেন, দুর্ঘটনার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আনফিট গাড়ি দায়ী।

সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কারো কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব গাড়ির মান ভালো না সেগুলোর কারণেই দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে।’

আবার একটি অচল গাড়ির কারণে তৈরি হয় অতিরিক্ত কালো ধোঁয়া, যা পরিবেশের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। এক গবেষণা বলছে, একটি পুরনো কার নতুন ১১টি কারের সমান দূষণ তৈরি করে। আর একটি পুরনো ট্রাক নতুন ২৪টি ট্রাকের সমান দূষণ সৃষ্টি করে।

দেশের মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গত হলে তা জরিমানাসহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় মাত্রার চেয়ে বেশি কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে চলা যান জব্দ করতে বলা হয়।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার কালের কণ্ঠকে জানান, এক গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে ঢাকার মোট বায়ুদূষণের ১৫ শতাংশ হচ্ছে যানবাহনের কারণে। এর মধ্যে বাস ছাড়াও সব ধরনের যানবাহন রয়েছে। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণেই কালো ধোঁয়া সৃষ্টি হয়।

স্ক্র্যাপ ছাড়া নতুন গাড়ি নেওয়া যাবে না : নীতিমালার খসড়ায় বলা হচ্ছে, কোনো যানের মেয়াদ শেষ হলে ওই যান স্ক্র্যাপ করতে হবে। স্ক্র্যাপ করার মতো গাড়ি থাকতে ওই যানের মালিক অন্য কোনো যানের নিবন্ধন পাবেন না।

কিভাবে স্ক্র্যাপ করতে হবে : স্ক্র্যাপ করার পুরো প্রক্রিয়াটি বিআরটিএর তত্ত্বাবধানে বেসরকারি পর্যায়ে হবে। স্ক্র্যাপযোগ্য মোটরযানের মালিক মূল কাগজপত্রসহ নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবেন। কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই শেষে সংশ্লিষ্ট মোটরযান স্ক্র্যাপ ভেন্ডরের কাছে হস্তান্তর করবে। স্ক্র্যাপ করার উদ্দেশ্যে শুধু কর্তৃপক্ষের নিয়োগ দেওয়া স্ক্র্যাপ ভেন্ডর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে স্ক্র্যাপ কার্যক্রম পরিচালনা হবে।

তবে পরিত্যক্ত মোটরযানের ক্ষেত্রে আদালত, পুলিশ, কাস্টমস বা অন্য যেকোনো সংস্থা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে স্ক্র্যাপ করার জন্য অনুরোধ করলে বিআরটিএ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পুলিশের কাছে আটক করা স্ক্র্যাপযোগ্য মোটরযান বিআরটিএ নিজ উদ্যোগেই স্ক্র্যাপ করতে পারবে। মোটরযানের চেসিস ও বডি এমনভাবে বিনষ্ট করবে, যাতে অন্য কোনো মোটরযানে ব্যবহারের উপযোগী না থাকে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নীতিমালাটা যৌক্তিক হলে খারাপ হবে না। তবে এতে যেন শুধু বাস-ট্রাক গুরুত্ব না পায়। ব্যক্তিগত গাড়ি, কার, মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য গাড়িও এই নীতিমালার আওতায় কড়াকড়িভাবে থাকতে হবে।’

কারা স্ক্র্যাপ করার উপযুক্ত : বিআরটিএ উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতি জেলায় নির্ধারিত সময়ের জন্য এক বা একাধিক স্ক্র্যাপ ভেন্ডর নিয়োগ করবে। তবে স্ক্র্যাপ ভেন্ডর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্ক্র্যাপ ভেন্ডরের প্রয়োজনীয়সংখ্যক আধুনিক উপকরণ থাকতে হবে। যেমন—গ্যাস কাটার, ক্রেন, শ্রেডার মেশিন, রেকার, হাইড্রলিক প্রেস মেশিনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/05/20/1281628