২০ মে ২০২৩, শনিবার, ১২:১৫

অনেকে এখনো খোলা আকাশের নিচে

সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপে খাবার পানির তীব্র সঙ্কট

ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতের সপ্তাহ পার হলেও সেন্টমার্টিন ও শাহপরী দ্বীপের ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে এখনো পায়নি কোনো ধরনের সহায়তা। তবে ঘূর্ণিঝড়ের পর সবচেয়ে বেশি সঙ্কট দেখা দিয়েছে খাবার পানির। রয়েছে খোলা আকাশের নিচে। আবার কেউ কেউ সহায়তা পেলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি। জনপ্রতিনিধিদের দাবি, মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে দ্রুত সহায়তার আওতায় আনা। তবে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত তালিকা তৈরির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত সবার মাঝে সহায়তা প্রদান করা হবে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রশাসন।

ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ও টেকনাফের উপকূলীয় শাহপরী দ্বীপ এলাকার বাসিন্দারা। এসব এলাকায় বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি, উপড়ে গেছে হাজারো গাছপালা ও ভেঙে গেছে পানের বরজ।

ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ কেউ তাৎক্ষণিক খাদ্যসহ নানা সহায়তা পেলেও অনেকে পায়নি। আর যারা সহায়তা পেয়েছে তা চাহিদার চেয়ে অপ্রতুল। এ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে বিধ্বস্ত বসতঘরে আশ্রয়ের পাশাপাশি খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। শাহপরীর দ্বীপের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলে পল্লীগুলো। এখানকার ৯৫ ভাগ ঘরবাড়িই বিধ্বস্ত হয়েছে।

সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপের অর্ধেকের বেশি নলকূপ থেকে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব নলকূপ থেকে পানি আসছে তাও লবণাক্ত। ফলে খাবার বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটের কবলে পড়েছেন তারা। বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া এলাকা ছাড়া অন্যান্য এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। তবে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনো বন্ধ আছে।

শাহপরীর দ্বীপ ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুস সালাম বলেন, তবে ঘূর্ণিঝড়ের পর সবচেয়ে বেশি সঙ্কট দেখা দিয়েছে খাবার পানির। সেগুলো মেরামতের ব্যস্ততার মধ্যেই এক-দুই কিলোমিটার দূর থেকে পানি এনে কোনো রকমে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন এই জালিয়া পাড়ার প্রায় ৫০০ পরিবার। এলাকায় পানি লবণাক্ত হওয়ায় আগে থেকেই সঙ্কট চলছিল। এখানে ডিপ টিউবওয়েলের সংখ্যাও কম। তার পরও পাইপ দিয়ে দুই-তিন কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনত জালিয়াপাড়ার মানুষ। বেড়িবাঁধের ওপর দেখা হয় নূর কায়েসের সাথে। কলসি কাঁধে নিয়ে পানি আনতে যাওয়ার পথে এই কিশোর জানায়, বেড়িবাঁধসংলগ্ন তাদের ছোট ঘরটি ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে গেছে। তার মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই ঘর গোছাতে ব্যস্ত। বাড়িতে খাবার পানি আনার দায়িত্ব পড়েছে তার কাঁধে।

সাবরাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূর হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে আমার ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শাহপরীর দ্বীপে। তার মধ্যে জালিয়াপাড়া জেলে পল্লীগুলো খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

‘আগে থেকে জালিয়াপাড়া বেড়িবাঁধ এলাকায় পানির সঙ্কট ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পর এই সঙ্কট আরো বেড়েছে। আশা করি, বিদ্যুৎ এলে এই সঙ্কট কেটে যাবে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সদস্য (মেম্বার) খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, মোখা-পরবর্তী দ্বীপের প্রধান সমস্যা এখন খাবার পানি। দ্বীপের বেশির ভাগ নলকূপ নষ্ট হয়ে গেছে। যে কয়েকটি নলকূপ থেকে পানি আসছে তা লবণাক্ত। ফলে তীব্র খাবার পানির সঙ্কট তৈরি হয়েছে। কোনো সময় দ্বীপের পানি লবণাক্ত ছিল না। এটিই প্রথম। এখন নতুন করে নলকূপ স্থাপন করা জরুরি। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে নতুন করে নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।

তিনি জানান, দ্বীপের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ শুকনো খাবার, চাল, ডালসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী ত্রাণ হিসেবে পেয়েছেন। তবে ঘর বিধ্বস্ত হওয়া পরিবারগুলো এখনো ঘর করতে পারেননি।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ২০০ পরিবারের জন্য ৪০০ বান্ডিল টিনসহ নানা উপকরণ ট্রলারযোগে পাঠানো হয়েছে। পানি সঙ্কট নিরসনে স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান জানিয়েছেন, দ্বীপে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। মোখার আঘাতে ব্যাপক সংখ্যক গাছ ভেঙে যাওয়ায় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তার স্বাভাবিক করে বিদ্যুৎ চালু করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়নের পক্ষে সহযোগিতা করা হবে। বিদ্যুৎ চালু হলে মোটরের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করলে পানির সমস্যা কিছুটা দূর হবে। এখন জরুরি ভিত্তিতে অন্তত ৫টি নলকূপ স্থাপন জরুরি।

তিনি জানান, দ্বীপে এখনো এক হাজার পরিবার খোলা আকাশের নিচে। এ অবস্থায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সরকারিভাবে কিছু টিন পাঠানো হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্যদের ঘর তৈরিতে সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে।

পানি লবণাক্ত হওয়ার কারণ হিসেবে কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী আবুল মঞ্জুর জানান, সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় স্বাভাবিকভাবে অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। একটু নিচেই পানির স্তর পাওয়ায় বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়। মোখার জোয়ারে লবণাক্ত পানি ওই স্তরের সাথে মিশে গেছে। ফলে পানি লবণাক্ত হয়ে গেছে। বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে তা এখনো লবণাক্ত আছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যেহারে বৃষ্টি হচ্ছে এটি কয়েক দিন স্বাভাবিক থাকলে পানি আবারো আগেরর অবস্থায় ফিরে যাবে। একই সাথে যেসব নলকূপ থেকে পানি আসছে না তা থেকেও পানি পাওয়া যাবে। এসব এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের পরামর্শ দেন তিনি।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানিয়েছেন, ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তালিকা হলেও চুড়ান্ত তালিকা এখনো হয়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করছেন। তা হাতে পেতে আরো কয়েক দিন লাগবে। চূড়ান্ত তালিকা পাওয়ার পর বলা যাবে কোথায়, কী ধরনের সহায়তা জরুরি পৌঁছানো দরকার।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/749259