২০ মে ২০২৩, শনিবার, ১২:১২

আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম নির্ধারণ

আন্তর্জাতিক বাজারদরের সাথে সমন্বয় করে প্রতিনিয়ত নির্ধারিত হতে যাচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম। সেপ্টেম্বর থেকে নতুন নিয়মে জ্বালানি তেলের দাম ঠিক হবে বলে নিশ্চিত করেছেন জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নতুন নিয়মে আর্ন্তজাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের দাম ঠিক হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে এখানে বাড়বে। আর কমলে কমানো হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেকটা পুঁজিবাজারের মত। প্রতিনিয়ত এর দাম পরিবর্তন হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতিদিন জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। রাজ্যভেদে দাম আলাদা থাকে। আবার অনেক উন্নত দেশ আন্তর্জাতিক বাজারদর ওঠানামা করলে মুহূর্তেই দাম সমন্বয় করে।

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জাপানসহ বিভিন্ন দেশ দিনে কয়েকবার দাম নির্ধারণ করে। তবে এখানে এখনই প্রতিদিন দাম সমন্বয় হবে না। আপাতত কিছুদিন পর পর দাম সমন্বয় করা হবে। কতদিন পর পর এই দাম সমন্বয় হবে তা এখনো ঠিক হয়নি। জ্বালানিখাত থেকে ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে নিতে এই পদক্ষেপ। এতে সাধারণ মানুষের কতটা উপকার হবে কিম্বা নিয়মটা স্বচ্ছ কিনা তা নিয়ে আলোচনার জায়গা তৈরি হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, সরকার এখন আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম নির্ধারণের দিকে এগোচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বাজারভিত্তিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্যাসের দাম নির্ধারণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। একইভাবে, বিদ্যুতের শুল্কও বাজার অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, নতুন বাজারভিত্তিক মূল্য ব্যবস্থা শিগগিরই চালু করা হবে, যার অধীনে কখনও কখনো দাম তাদের আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ভিত্তিতে বাড়বে এবং আবার কখনো কমবে। এখন গ্যাসের জন্য যে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় সরকার।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে জ্বালানি তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয় হওয়ার আগে এর কর প্রক্রিয়া ঠিক হওয়া উচিৎ। এর কর যদি বেশি থাকে তবে দাম কমার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে অনেক অপেক্ষা করতে হবে। এখন তেল আমদানিতে সবমিলিয়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ কর নেয়া হয়।

অর্থাৎ ১০০ টাকার মধ্যে ৩৪ টাকাই নেওয়া হচ্ছে বন্দরে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আরও ১৫ শতাংশ কর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এভাবে কর বাড়াতে থাকলে সব সময় ভর্তুকিতেই থাকবে বিপিসি। তেল তো আর বিলাশবহুল পণ্য নয়। যেমন, ব্যক্তিগত গাড়ি বিলাশবহুল বলে এর কর বেশি। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও যদি সেটা করা হয় তবে আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক না কমলে সুফল সাধারণ ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে সময় লাগবে। তাই সবার আগে কর কাঠামো ঠিক করা দরকার। কিন্তু কর বেশি আবার ভর্তুকি থাকছে না এমন পরিস্থিতিতে সব দায় ভোক্তার।

করোনার পর যখন আন্তর্জাতিক বাজারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল জ্বালানি তেলের দাম তখন ভারতসহ অনেক দেশ দেশের ভেতরে নিজস্ব কর কমিয়ে দিয়েছিল। এতে জ্বালানি তেলের দাম তাদের খুব বেশি বাড়াতে হয়নি।

আন্তর্জাতিক বাজারে এখন জ্বালানি তেলের দাম তুলনামূলক কম। এর সাথে সমন্বয় করলে ডিজেলের দাম কিছুটা কমবে। বেশি কমবে পেট্রোল ও অকটেনের দাম। কিন্তু যদি এনবি আর কর বা শুল্ক বাড়িয়ে দেয় তবে দেখা যাবে এখনই লোকসান গুনতে হবে বিপিসিকে। বিপিসির কাছ থেকে উচ্চহারে কর আদায় করা হচ্ছে। আবার বলা হচ্ছে ভর্তুকির কথা। এদিকে ঋণ দিতে আইএমএফ এর মূল পরামর্শ জ্বালানিখাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়া। আর সেজন্য এরআগে বিদ্যুৎ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে কয়েকদফা। বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানোর কথা শোনা যাচ্ছে। শুধু আইএমএফ এর ঋণ নয়, আরও অনেক আগে থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ জ্বালানিকে ভর্তুকি মুক্ত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সেবার পরিবর্তে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ জ্বালানিকে। ভর্তুকি দেয়া হয় না অনেক বছর। এখন দেয়া হয় ঋণ।

চলতি অর্থবছর জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দিতে কোনো বরাদ্দ নেই। ভর্তুকি দিতে সংশোধিত বাজেটে ১৯ হাজার ৩৫৭ টাকা চেয়েছিল জ্বালানি বিভাগ; কিন্তু দেয়া হয়নি। বিদ্যুৎখাতে চলতি অর্থবছর ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ ছিল। পরে সংশোধিত বাজেটে আরও ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। এর প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার পেয়েছে। পরের কিস্তি পাওয়া যাবে ডিসেম্বরে। ওই কিস্তি ছাড়ের আগে সেপ্টেম্বর মাসেই জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের নতুন নিয়ম কার্যকর করা হবে।

আইএমএফের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী (এমওইউ), জ্বালানি তেলে শূন্য ভর্তুকি নীতি বাস্তবায়ন করা হবে।

ভোক্তাদের কি লাভ?
বিশ্ব বাজারের সাথে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সব সময় সমন্বয় করার উদ্যোগটি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও স্থানীয় বাজারে কমানো হয়নি। এই নিয়ম বাস্তবায়ন হলে এটা আর হবে না। তবে যখন বেশি দাম হবে তখন সেটাও দিতে হবে। এখানে আর কোনো ভর্তুকি থাকবে না। এখন যদি এই নিয়ম এখনকার মত হয় যে, যখন দাম বাড়বে তখন সমন্বয় করবে আর যখন আন্তর্জাতিক বাজারে কমবে তখন করবে নাÑ তাহলে আর তার সুফল সাধারণ মানুষ পাবে না। পরিবহন ভাড়া ও দ্রব্যমূল্য চ্যালেঞ্জের বরাবরই জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহন ভাড়া ও দ্রব্যমূল্যও বাড়ে।

এখন প্রতিনিয়ত জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বা কমলে পরিবহন ভাড়া কীভাবে ঠিক হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। যখন তেলের দাম কমবে তখন পরিবহন ভাড়া কি কমবে? এনিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ অভিজ্ঞতা। আগে যে কয়েকবার তেলের দাম কমেছে তাতে পরিবহন ভাড়া কমেনি। কিন্তু বাড়লে রাতারাতি ভাড়া বেড়েছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ হলে পরিবহনের ভাড়া কীভাবে নির্ধারণ করা হবে, তা একটা জটিল বিষয়। প্রতিবেশী দেশ বা অন্য যেসব দেশ এই ফর্মুলায় চলছে সেটা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।

এখন প্রতিমাসে যেভাবে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি, সেভাবেই জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া ঠিক করা নিয়ে আলোচনা চলছে।

এটা নতুন কোনো নিয়ম নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই এভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়।
আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে বিশ্বে এখন প্রধানত তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। অধিকাংশ দেশ বাজার দরের সাথে সমন্বয় পদ্ধতি অনুসরণ করে। আবার কোনও কোনও দেশ সর্বোচ্চ দর বা প্রাইস সিলিং পদ্ধতি অনুসরণ করে। আর বাংলাদেশের মত অনেক দেশ নির্ধারিত দরে বিক্রি করে। গত বছরের ১৩ই ডিসেম্বর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের বৈঠকে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে প্রতিনিয়ত দাম সমন্বয় করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

https://dailysangram.info/post/525024