২০ মে ২০২৩, শনিবার, ১২:০৫

শিক্ষায় করোনা পূর্ব ধারা ফিরিয়ে আনা

-এ বি এম ফজলুল করীম

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে এমনিতেই অনিশ্চয়তা ও ধ্বংসের দিকে ধাবিত। তার মধ্যে করোনাজনিত লকডাউনের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণায় শিক্ষাব্যবস্থায় চরম অচলবস্থার সৃষ্টি হয়। অথচ ভারতসহ পৃথিবীর বহু দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়েছিল। আমাদের দেশে ২০২০ সালের ১৬ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একটানা দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। কোভিড-১৯ এর কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। এমতাবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে পড়েছে। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার সেই সমস্যাগুলো থেকে নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা উপস্থাপন করা হলো :

কিন্ডারগার্টেন স্কুল, ইবতেদায়ি মাদরাসাসহ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
করোনার কারণে বিরাটসংখ্যক শিক্ষক কর্মচারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ছাঁটাই করায় বহু শিক্ষক বেকার হয়ে পড়েছে। ফলে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে মানবতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। বহু শিক্ষক শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে রিকসা চালানো, কাঁচা তরিতরকারীসহ নিম্নমানের পেশায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।

পরপর দু’বার স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীদের অটো প্রমোশন দেয়া শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রায় দেড় বছরের সেশন জট সৃষ্টি হয়েছে।

ইউনেস্কোর গবেষণায় দেখা যায়, দীর্ঘ দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের প্রায় ৪ (চার) কোটি শিক্ষার্থী ও বিরাটসংখ্যক শিক্ষক নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এ ধরনের নানা সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকার, অভিভাবক, শিক্ষক কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের তথা আমাদের প্রধান করণীয় নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা উপস্থাপন করা হলো-

প্রথমত, শিক্ষাক্ষেত্রে আগের ধারা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত অবিলম্বে কালক্ষেপণ না করে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়ে শিক্ষা বিষয়ক একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন এবং ওই কমিটির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন নীতিমালা তৈরি করে তা কার্যকর করা। অর্থাৎ তার আলেকে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা।

দ্বিতীয়ত, সর্বস্তরের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব সক্ষমতা ও বাস্তবতা অনুযায়ী রিকভারি প্ল্যান তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন। ঝরে পড়া স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ফের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনার বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা কার্যকর করা।

তৃতীয়ত, সেশনজট কমানোর লক্ষ্যে দৈনিক কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে বিদ্যমান অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারের সময়কাল গ্রহণযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে হবে। যেমন : সেমিস্টার ছয় মাসের স্থলে চার মাস এবং বার্ষিক পরীক্ষা এক বছরের স্থলে ৮ মাস করা যেতে পারে। আর তা করতে পারলে শিক্ষা বর্ষের সেশনজট কমবে এবং শিক্ষার্থীদেরকে অটো প্রমোশন দেয়ার প্রয়োজন হবে না। ফলে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

চতুর্থত, পরিকল্পিতভাবে পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে। পরীক্ষার জন্য মুখস্থ করার চেয়ে বাস্তবে বোঝার ওপর জোর দিতে হবে এবং সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নের চেয়ে শিক্ষার জন্য নিয়মিত ধারাবাহিক গঠনমূলক মূল্যায়নের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত জ্ঞানর্জন করতে পারে।

পঞ্চমত, শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে দক্ষ ও উপযুক্ত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ও মানসম্মত শিক্ষক তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা সরকারি ও বেসরকারিভাবে আরো বাড়াতে হবে। শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রের বাজেটও বৃদ্ধি করতে হবে।

ষষ্ঠত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
সপ্তমত, শিক্ষাব্যবস্থায় যাবতীয় অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়প্রীতি, নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করে প্রকৃত মেধাবীদেরকে শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। বেসরকারি ও সরকারিভাবে শিক্ষকদের তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কোচিং নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।

অষ্টমত, শিক্ষাদান ও শেখার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেন অতিরিক্ত অনলাইনে (ফেসবুক, ইউটিউব, গেইম, অসামাজিক সাইট ইত্যাদিতে) আসক্ত না হয়, সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। অনলাইন ডিভাইস অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যতদূর সম্ভব শিক্ষার্থীদের ডিভাইস-স্ক্রিন থেকে দূরে রাখতে হবে। কম ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় শিক্ষার্থীদেরকে মোবাইলের পরিবর্তে ডেস্কটপ/লেপটপ ব্যবহারের ব্যবস্থা অভিভাবক ও শিক্ষকদের করা দরকার।

নবমত, ধর্মীয় শিক্ষা নার্সারি থেকে সব শ্রেণীতে রাখতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় ও নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি বৃদ্ধি পায়। যাতে করে তারা নৈতিক চরিত্র ও মানবিক গুণাবলী অর্জন করে দেশের সম্পদে পরিণত হতে পারে।

দশমত, কিন্ডারগার্টেন স্কুল, ইবতেদায়ি মাদরাসাসহ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ ও সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য।

এ ছাড়াও শিক্ষকদের সৎ, যোগ্য আলোকিত মানুষ হতে হবে এবং পাঁচটি স্তরে সৎ, যোগ্য ও আদর্শ মানুষ তৈরির জন্য শিক্ষকদের কাজ করতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সহকর্মী শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে সুশিক্ষিত করার কাজে শিক্ষকদের আত্মনিয়োগ করতে হবে। সরকারের উচিত অটো প্রমোশন সর্ববস্থায় বন্ধ রাখা এবং পরীক্ষা ছাড়া কোনো প্রমোশন না দেয়া। তবেই জাতীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ করা সম্ভব হবে। দেশে সৎ, যোগ্য জনশক্তি হিসেবে শিক্ষার্থীরা গড়ে উঠবে।

বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদরা মনে করেন, সরকারের উচিত অবিলম্বে উপরে উল্লিখিত বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে আগের ধারা ফিরিয়ে আনার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাহলেই আশা করা যায় দেশে শিক্ষাব্যবস্থার স্থবিরতা কমে যাবে এবং শিক্ষার্থীদের যথাযথ মেধার বিকাশ সম্ভব হবে। দেশে আবার শিক্ষাব্যবস্থায় আগের ধারা ফিরে আসবে। জাতির বিবেক ও আদর্শ মানুষ তৈরির কারিগর শিক্ষকরা আশা করা যায় তাদের পূর্ব মর্যাদায় আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিনেট সদস্য

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/749133