১৯ মে ২০২৩, শুক্রবার, ২:৫৫

ডলার সংকট দ্রব্যমূল্যকে উসকে দেবে

মূল্যস্ফীতির উত্তাপ আর ডলার সংকটে পুড়ছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বাড়ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি। দ্রব্যমূল্য যেনো লাগামহীন ঘোড়া। রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স আসা কমেছে। রিজার্ভেও নিম্নগামী। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে মূল্যস্ফীতির ওপর সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ডলার সংকট দ্রব্যমূল্যকে উসকে দিচ্ছে বা দিবে।

তারা বলছেন, নতুন অর্থবছরের বাজেটে মূল গুরুত্ব দিতে হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর। সেইসঙ্গে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর দিকেও নজর দিতে হবে। তবে, নির্বাচনী বছর হওয়ায় সরকারের জন্য এ বাজেট হবে বেশ জটিল ও কঠিন। উচ্চাভিলাসী না হয়ে সংযত বা নিয়ন্ত্রিত বাজেট দিতে হবে। সম্ভব হলে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়াতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে এখনকার মতো এক কোটি মানুষকে আগামী অর্থবছরে সুবিধা দিতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ উপাত্ত অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এ চাপ মাথায় রেখে আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ের খসড়া করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এটি আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছর বাজেটের আকার প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা বাড়বে।

এ বাজেটে সার, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ বাড়তি বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা রাখা হয়েছিল। পরে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা করা হয়। নতুন অর্থবছরের বাজেটে এসব খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ১৭ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের এপ্রিলে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৫০৫ কোটি ডলার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৯৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশ আয় কম হয়েছে। শুধু লক্ষ্যমাত্রা থেকে কম হয়নি, গত বছরের তুলনায়ও রপ্তানি আয় অনেক কমেছে। গত বছরের এপ্রিলে রপ্তানি আয় ছিল ৪৭৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের এপ্রিলে রেমিট্যান্স আসে ২ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ।

অর্থনীতির এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে নতুন অর্থবছরের বাজেটে মূল গুরুত্ব কোথায় দেওয়া উচিত জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেটে মূল গুরুত্ব দিতে হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে। তবে মূল্যস্ফীতি অনেকটা বহির্বিশ্বের কারণে হচ্ছে, এটাকে আমাদের অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। কাজেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে এবং পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে। সেইসঙ্গে এটি যাতে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের রিজার্ভ পরিস্থিতি ক্রমশই খারাপ হচ্ছে। রিজার্ভ উন্নতি করার জন্য আমাদের আরও বেশি সংখ্যক দক্ষ শ্রমিক বাইরে পাঠাতে হবে। রপ্তানি আয় কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে। ডলার সংকট দ্রব্যমূল্যকে উসকে দিচ্ছে বা দিবে। এজন্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং ডলারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। তা না হলে দ্রব্যমূল্য কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। আগামী বাজেটে বিষয়টি সামনে রাখতে হবে। তা না হলে মূল্যস্ফীতির যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবেলা করা কঠিন হবে।

তিনি আরও বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের মহার্ঘভাতার একটা কথা উঠেছে। এটা শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের, অন্য যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের কী হবে? যারা বেসরকারি খাতে কাজ করেন বা কাজ করেন না তাদের জন্য কী মহার্ঘভাতা দেওয়া হবে? এটা বৈষম্যমূলক পলিসি, কাজেই আমি এটা সমর্থন করি না।

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে এবং আমি বহুদিন ধরে বলে আসছি আমাদের যে রাজস্ব আহরণ, তা আনুপাতিক হারে নেপালের থেকে অর্ধেক। যেখানে নেপালের মাথাপিছু আয় আমাদের থেকে অনেক কম। কাজেই রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে।

একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে নির্বাচনী বছরের বাজেট। সার্বিকভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট কেমন হওয়া উচিত? এমন প্রশ্নের উত্তরে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ বছরটা সংকটের বছর। যে সংকটটা গত বছর শুরু হয়েছিল, সেটা এখন পর্যন্ত আমরা ম্যানেজ করতে পারিনি। সংকটটা দাবানলের মতো ছড়ায়নি, তবে ধিক ধিক করে জ্বলছে, কিন্তু নেভানো হয়নি বা যায়নি।

এ প্রেক্ষাপটে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি এ বছর প্রবৃদ্ধি এত বেশি হবে না। আমদানি অনেক কমে গেছে। আমদানি কমই থাকবে, বাড়ার সম্ভাবনা নেই। রেমিট্যান্স বাড়ছে না, রপ্তানি আয়ও কমের দিকে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির পরিবেশ বাজেটের দিকে থেকে খুবই জটিল। এ প্রেক্ষাপটে যে বাজেট আসছে, মোটামুটি বলা যায় এটা সংযত হবে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন এবারের বাজেট ছোট আকারের হবে বলেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন, বাজেট ছোট হলেও সমস্যা হবে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হয়তো পূরণ হবে না এবং ব্যয় সংকোচন হয়তো আরও করতে হবে। কিন্তু সামনে নির্বাচন, সুতরাং ব্যয় সংকোচন করা কঠিন। ব্যয় সংকোচন রাজনৈতিকভাবে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে না। সবদিক দিয়ে একটা ডিফিক্যাল্ট পরিস্থিতিতে এ বাজেটটা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকার যে পলিসিগুলো নিয়েছে, খুব বেশি যে আস্থার সৃষ্টি করবে তা নয়। এখনো ডলার সংকট চলমান। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে এবং কমার কোনো লক্ষণ নেই। সামগ্রিক পরিস্থিতির যেহেতু উন্নতি হয়নি, এ বাজেটটাও সরকারের জন্য ডিফিক্যাল্ট হবে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ঢাকায়ও লোডশেডিং শুরু হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানির সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ কমার জন্য প্রথমে কষ্ট একটু বেশি করতে হবে, তারপর ফল মিলবে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সেরকম কোনো পদক্ষেপ আমরা এখনো নেইনি। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে হলে সুদের হার বাড়াতে হবে। সুদের হার এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। এতদিন পর এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। শুধু আলোচনা করলে তো হবে না, অ্যাকশনে যেতে হবে। সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো মনে করে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, ডলার সংকট কেটে যাবে। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। আশা করলে হবে না, কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এক কোটি মানুষকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এটা ঠিক আছে। আগামী বাজেটেও এক কোটি মানুষকে এ সুবিধা দিতে হবে। তবে বণ্টনটা যেন ঠিকমতো হয়। অর্থাৎ যারা দরিদ্র তারাই যেন পায়।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখতও মনে করেন নতুন অর্থবছরের বাজেটে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে। তিনি বলেন, প্রধান বিষয় হলো আমরা মূল্যস্ফীতির একটা চাপের মধ্যে আছি এবং এটা সহসা চলে যাচ্ছে না। সুতরাং সরকারি ব্যয়টা একটু নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। যেসব ব্যয় উৎপাদনমুখী হবে, সেগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে মূল্যস্ফীতির চাপটা সহনশীল রাখা যায়।

তিনি বলেন, এটা নির্বাচনী বছরের বাজেট। তাই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর যে কর্মসূচিগুলো আছে, সেগুলো আরও জোরদার করতে হবে। এগুলো এমনিতেই দরকার। আর নির্বাচনী বছরে আরও বেশি দরকার।

আমাদের কর-জিডিপি রেশিও অনেক কম। সেটা সরকারও চায় বাড়াতে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আগে এটা সম্ভব হয়নি। এখন বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপ আছে। তাছাড়া বিশ্ব অর্থনীতির যে অবস্থা, তাতে আমরা যদি রাজস্ব আয় বাড়াতে না পরি তাহলে আমাদের জন্য অসুবিধা হবে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এবারের বাজেটে ঘাটতি বেশি ধরা ঠিক হবে না। আমাদের বাজেট ঘাটতি সব সময় জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে থেকেছে, আগামীতেও এটা অতিক্রম করার কোনো কারণ নেই।

সরকারি কর্মকর্তাদের মহার্ঘভাতার বিষয়ে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি হয়েছে, মানুষের জীবন-যাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। এখন নতুন করে একটা পে-কমিশন করাও ডিফিক্যাল্ট। সেজন্য এসব ক্ষেত্রে মহার্ঘভাতার মতো সুবিধা দেওয়া হয়। এবারও হয়তো সরকার সেটা করতে পারে।

https://dailysangram.info/post/524910