১৯ মে ২০২৩, শুক্রবার, ২:৫২

বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গরুর গোশতের দাম সর্বোচ্চ

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: উচ্চ মূল্যের কারণে গরুর গোশত বর্তমানে উচ্চবিত্তের খাবারে পরিণত হয়েছে। গোটা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে গরুর গোশতের দাম সবচেয়ে বেশি। আর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গরুর গোশতের দাম তিনগুণ। গোশত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় দাম কমিয়ে আনতে আসন্ন বাজেটে গোশত ও গোশতজাত পণ্যকে নিত্যপণ্যের ক্যাটাগরিতে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই পণ্যের উৎসে অগ্রিম আয়কর বর্তমানে গড়ে ৫-৭ শতাংশ। এটা কমিয়ে ২ শতাংশ করা হতে পারে। কারণ, ৫-৭ শতাংশ অগ্রিম আয়কর দেশের গোশত উৎপাদন ও সরবরাহকারী ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম গোশত ও গোশতজাত পণ্যের ওপর অগ্রিম আয়কর কমানোসহ এই পণ্যকে নিত্যপণ্যের ক্যাটাগরিতে আনার প্রস্তাব দিয়েছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গোশত ও গোশতজাত পণ্যের ওপর অগ্রিম আয়কর কমানোর প্রস্তাব গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। সে কারণে বাজেটে গোশতের অগ্রিম কর কমানোর প্রস্তাবনা আসতে পারে। এনবিআর ও অর্থ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গোশতের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের মানুষের আমিষের ঘাটতি হচ্ছে। এটা মেটানোর জন্য অবশ্যই এ পণ্যকে নিত্যপণ্যের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবটি অবশ্যই বিবেচনায় আনা দরকার। তারা বলেন, গরুর গোশত মুসলমানদের অনেক পছন্দের খাবার। কয়েক বছরের মধ্যে এ পণ্যের দাম প্রতি কেজি ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০০ টাকা হয়েছে। গোশতের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এতে দেশের মানুষ আমিষের ঘাটতিতে পড়ছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের গরুর গোশত যেখানে প্রতি কেজি ৮০০ টাকা, সেখানে পাকিস্তানে গরুর গোশতের দাম বর্তমানে ৬০০ রুপি যা বাংলাদেশের টাকায় ২৩০ টাকার সমান। অন্যদিকে ভারতে প্রতি কেজি গোশতের দাম ১৭৫ রুপি যা বাংলদেশি টাকায় হয় ২২৪ টাকার মতো। ভারতের কলকাতায় ১৭৫ রুপি থেকে ১৮০ রুপির মধ্যে গরুর গোশত পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালে প্রতি কেজি গরুর গোশতের দাম ০.৭৬ ইউএস ডলার মানে ৮০ টাকা, ভুটানে ১৬০ নুল বা ২০৭ টাকা, মিয়ানমারে ৫.৬৬ ইউএস ডলার বা ৫৬৭ টাকা। দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গরুর গোশতের দাম তিনগুণ।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি গরুর গোশতের গড় দাম যেখানে সাড়ে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা সেখানে বাংলাদেশে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ভারত বাংলাদেশে গবাদি পশু রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করার আগে ঢাকার বাজারে এক কেজি গরুর গোশতের দাম ছিল ২৩০-২৫০ টাকা। নিষেধাজ্ঞার আগে চোরাচালান করা ভারতীয় গরু বাংলাদেশের চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করত। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা প্রায় ২০ লাখ গরু বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে গরুর গোশতের বিশ্বব্যাপী গড় মূল্য ছিল ৪.৬৩ ডলার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিময় হারের ওপর ভিত্তি করে হিসেব করলে প্রতি কেজি প্রায় ৩৬০ টাকা।

ভারতের গবাদি পশু রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে প্রাণিসম্পদ খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য সত্ত্বেও গত ৭-৮ বছরে বাংলাদেশে গরু ও খাসির গোশতের দাম বেড়েছে। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর, মোদি সরকার বাংলাদেশে গবাদি পশু রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। যা বাংলাদেশের পশুসম্পদ খাতের ব্যাপক উন্নয়নে সহায়তা করেছিল বলে জানান খামারীরা। তবে ক্রেতারা বলছেন, গরু ও খাসির গোশতের দাম নিম্ন ও মধ্যম আয়ের গ্রাহকদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে গরুর গোশতের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সার্বিক মূল্যস্ফীতিকে দায়ী করছেন।

গোশতের দাম কমাতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর চিঠিতে বলা হয়েছে গোশত উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ১০-১২ শতাংশ গ্রস মার্জিন দিয়ে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। ফলে গোশত ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ নিট লাভ মার্জিন ১-৩ শতাংশের বেশি হওয়া সম্ভব হয় না। আয়কর অধ্যাদেশ অনুসারে গোশত ও গোশতজাত পণ্য সরবরাহের ওপর সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ পর্যন্ত উৎসে কর কর্তন করা হয়ে থাকে; যা এই খাতের নিট মার্জিনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর বিধি-১৬ এর ৫২ ধারার টেবিল-২-এ চাল, ডাল, গম, ময়দা, চিনি, তেল, আলু, খেজুর, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, পাট, সুতাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ২ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন আরোপিত রয়েছে। গোশত ও গোশতজাত পণ্যকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে বিবেচনা করে একই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী। মন্ত্রীর ওই প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে এনবিআর।

এর আগে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক-কর কমানোর দাবি করেছিল। সংস্থাটি বলেছে, শুল্ক-কর কমানো হলে নি¤œ ও সীমিত আয়ের মানুষেরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন। বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এ কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। তাই আগামী বাজেটে আমদানি ও স্থানীয় পর্যায়ে বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক-কর কমানোর প্রস্তাব করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি। সিপিডির পক্ষ থেকে আমদানি করা ২৮টি পণ্যের একটি তালিকাও এনবিআরকে দেওয়া হয়েছে। সিপিডি যেসব পণ্যের শুল্ক-কর কমানোর প্রস্তাব করেছিল তার মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের হিমায়িত পশুর গোশত (গরু, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদি), মুরগি, মাছ (রুই, কাতলা, পাঙাশ, কার্প ইত্যাদি), ইলিশ, বিভিন্ন ধরনের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, টমেটো, পেঁয়াজ, রসুন, খেজুর, দারুচিনি, গোলমরিচ (পিপার), ধনিয়া, আদা, হলুদ, ভুট্টা, চাল, পাম তেল ও লবণ। অন্যদিকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির বিবেচনায় সরকার পোল্ট্রি ও মৎস্য শিল্পের কর ছাড় প্রত্যাহারেও উদ্যোগ নিয়েছে। এনবিআরের মতে হাঁস-মুরগি ও মাছ এখন আমদানি হয় না। তাই বিদেশি উৎপাদকদের সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। এই দুটি খাতে কর অব্যাহতির প্রয়োজন নেই। বরং আমদানিতে কর ছাড় প্রত্যাহার হলে স্থানীয় শিল্পগুলো নিজেদের মানের উন্নয়ন ঘটাতে বাধ্য হবে বলে মনে করে এনবি আরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

বাংলাদেশে গরুর গোশতের দাম সবচেয়ে বেশি। অথচ গরুর গোশত খাওয়ার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে নেই। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গরুর গোশত খাওয়ার তালিকায় ভারতের অবস্থান ৫ম, ২০২২ সালে সেখানে গরুর গোশত খাওয়া হয়েছে ২৯ লক্ষ মেট্রিক টন। এই তালিকায় পাকিস্তান আছে ৮ম অবস্থানে ২০২০ এ ওরা ১৭.৫ লক্ষ মেট্রিক টন গরুর গোশত খেয়েছে। গরুর গোশত খাওয়ার পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ না থাকলেও এক হিসাবে বলা হচ্ছে- গত বছর কোরবানি ঈদে প্রায় ৪৬ লক্ষ গরু ও মহিষ বিক্রি হয়েছে। তার মধ্যে ধরে নিলাম ৩০ লক্ষ গরু বিক্রি হয়েছে। প্রত্যেক গরু গড়ে ৩মণ অর্থাৎ ১২০ কেজি করে গোশত ধরলেও ৩.৫ লাখ মেট্রিক টনের উপরে উঠেনা। আমরা জানি আমাদের দেশের মানুষ কোরবানী ঈদের সময় যে গোশত পায় তাই বছরের মূল গরুর গোশতের যোগান। যদি সারা বছর গরু খাওয়ার হিসেব এর ডাবলও ধরি তাও তা ৭ লক্ষ মেট্রিক টন ছাড়ায় না।

দাম বাড়ার কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, ভারতের গরুর গোশত রপ্তানি নিষিদ্ধ করা, জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া এবং গবাদি পশুর খাদ্যের উচ্চমূল্য দেশের গরুর গোশতের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। বিডিএফএ’র মতে, কিছু সরকারি পদক্ষেপ এবং প্রণোদনা বাংলাদেশে গোশতের দাম ২০-২৫% কমাতে সাহায্য করতে পারে। এর মধ্যে দুগ্ধ খামারের বিদ্যুতের দাম, বাণিজ্যিক ও গৃহস্থালির মতো একটি বিশেষ হার অনুসারে থাকা দরকার। বর্তমান সরকারের নীতি গরু পালনকে উৎসাহিত করে, তাই বিদ্যুতের দাম বাণিজ্যিক নয়, স্বাভাবিক হওয়া উচিত। সরকারের উচিত দুগ্ধ খামারিদের ৩-৪% সুদে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা করা এবং মাংসের উৎপাদন বাড়াতে দেশে ব্রাহ্মণ, সিমেন্টাল ও অ্যাঙ্গাসের মতো জাতের গরু আমদানি উৎসাহিত করা। একই কথা ছাগলের ক্ষেত্রেও। সরকারের উচিত আফ্রিকান জাতের যেমন বোয়ার বা কালাহারি এবং ভারতীয় জাতের তোতাপুরি ও যমুনাপারির মতো ছাগল মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমদানির অনুমতি দেয়া।

ডিপার্টমেন্ট অব লাইভস্টক সার্ভিসেস’র (ডিএলএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ১.৩ মিলিয়ন টন মাংস উৎপাদন করেছিল, যা ২০২০ অর্থবছরে বেড়ে ৭.৫ মিলিয়ন টনে দাঁড়িয়েছে। গত ৭-৮ বছরে বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ গবাদি পশু পালনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ফলে বাংলাদেশ গবাদি পশু পালনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। কোরবানির মৌসুমে আমাদের ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভর করতে হতো, কিন্তু স্থানীয়ভাবে পালন করা ষাঁড়ই ঈদ উদযাপনে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে পারে।

কয়েক বছর আগে মোটাতাজা ষাঁড়ের পরিসংখ্যান সংগ্রহ শুরু করা এক গবেষণায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দেখেছিল, ২০১৭ সালে দেশে ৩.৩৪ মিলিয়ন ভালো জাতের ও স্বাস্থ্যের ষাঁড় ছিল। যা ২০২১ সালে ১৬% বৃদ্ধি পেয়ে ৩.৮৬ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। ডিএলএস’র মতে, বাংলাদেশে ৬ লাখ ৯৮ হাজার গবাদি পশুর খামারি রয়েছে, যা ২০১৫ সালে ৩ লাখ ছিল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারত থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সীমান্তে আনা গবাদি পশুর সংখ্যা ২০১৪ অর্থবছরে ২.১ মিলিয়ন ছিল। ২০২০ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ যা আগের বছরের ৫ লাখ ৪২ হাজারের থেকে অর্ধেকেরও কম। মাত্র ৬ বছরের মধ্যে ৯০% কমে গেছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, চলমান মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষ সমস্যায় পড়েছে। জনগণ যাতে স্বাভাবিকভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে সেটি নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর আমদানিতে অগ্রিম আয়কর, অগ্রিম কর এবং নিয়ন্ত্রক শুল্ক অপসারণের সুপারিশ করেন।

https://dailysangram.info/post/524908