১৯ মে ২০২৩, শুক্রবার, ২:৪৫

মামলাজটে ভোগান্তি বাড়ছে!

-মো. তোফাজ্জল বিন আমীন

আইন যতই সুন্দর ও পরিপাটি হোক তা যদি বাস্তবায়নকারীর বিবেককে জাগ্রত করতে না পারে তাহলে সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না; বরং জুলুম হয়। ন্যায়বিচার সূর্য থেকে আসে না। ন্যায়বিচার রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। যে সমাজ বা রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত সেখানে সংঘাত, সহিংসতা ও খুনোখুনি হয় না। কারণ সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। ন্যায়বিচারের সংজ্ঞা বিভিন্ন মনীষী বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। অধ্যাপক বার্কারের মতে, লাতিন শব্দ Jus, Justus বা Justitia থেকে Justice শব্দের উৎপত্তি। তাঁর মতে রাষ্ট্রের সহায়তায় মানব সম্পর্ককে সুবিন্যস্ত করার নীতি হল ন্যায়বিচার। আইনশাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্রের ভাষ্যমতে কোন ব্যক্তির প্রাপ্য কী হবে এবং তার জন্য ভাল ও মন্দের ভাগের সঠিক অনুপাত কী তাকে ন্যায়বিচার বলা হয়। আদালত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সবার ভাগ্যে ন্যায়বিচার জুটে না। ইংরেজীতে একটি কথা আছে Justice delayed is Justice denied. অর্থাৎ বিচার বিলম্বিত হলে ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করা হয়। আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ও রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট হওয়ায় মামলাজট বাড়ছে, বাড়ছে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মামলাজট বেড়ে যাওয়া মোটেও সুখকর নয়!

সেই ছোটবেলায় পড়েছি ‘‘ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।’’ দেশের মামলাগুলোর অবস্থাও তা-ই হয়েছে। একদিনে মামলাজট সৃষ্টি হয়নি। সময়ের কাজ যদি সময়ে শেষ করা হতো তাহলে মামলাজট হতো না। কেন হয়েছে তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। যুগের পর যুগ ধরে মামলা চলছে। কিন্তু মামলা শেষ হচ্ছে না। প্রসঙ্গক্রমে ব্রিটিশ বিচারপতি লর্ড ডেনিং এর উক্তি মনে পড়ে গেল। ১৯৪৯ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ বিচারপতি লর্ড ডেনিং বলেছিলেন, কেউ আশা করেন না যে নির্বাহী বিভাগ সর্বদা পাপমুক্ত থাকবে। তারা পাপের দায়ে অভিযুক্ত হবে। কারণ তাঁর হাতেই ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ করা হলে সেটি হবে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র। আর অপব্যবহার করলে সেটি হবে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র। লর্ড ডেনিং এর সাহসী উচ্চারণ বিশ্বের অনেক দেশের জন্য প্রযোজ্য। মামলা মোকদ্দমার কথা শুনলেই গা শিউরে উঠে। মনের মধ্যে ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়।

কারণ মামলার ব্যয় মেটাতে গিয়ে চোখের সামনে বহু পরিবারকে বসতভিটা ছাড়তে দেখেছি। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিটি মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও সময়ক্ষেপন হওয়ার বিষয়টি তদারকি করা হলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো ন্যায়বিচার পেত। কিন্তু ন্যায়বিচার পাওয়া তো দূরের কথা উল্টো অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেশে দুই ধরনের মামলা বেশি হয়। একটি হচ্ছে দেওয়ানী মামলা। অপরটি হচ্ছে ফৌজদারী মামলা। অধিকার ও ক্ষতিপূরণ দাবির জন্য যে মামলা দায়ের করা হয় তাকে দেওয়ানী মামলা এবং ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তি শৃঙ্খলা বিঘœ হওয়ার দরুন যে মামলার সৃষ্টি হয় তাকে ফৌজদারী মামলা বলা হয়। নি¤œ আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালতে পর্যন্ত লাখো মামলার স্তূপ পড়ে আছে। কিন্তু নিষ্পত্তি হচ্ছে না। সুতরাং এ ব্যাপারে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন কেমন তা বুঝার জন্য আইনের বড় বড় বই পড়তে হয় না। দেশটির মামলার সংখ্যাই বলে দেয় আইনের শাসনের নমুনা কেমন। সম্প্রতি মাননীয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশের আদালতে ৪০ লাখ ৪ হাজার ৭টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তার মধ্যে দেওয়ানী মামলা ১৬ লাখ ৪৭ হাজার ৭৯০টি, ফৌজদারী মামলা ২৪ লাখ ১০ হাজার ৪৪৪টি এবং অন্যান্য ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮৯টি। (সূত্র : ১ ফেব্রেুয়ারি ২০২৩) নিকট অতীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে বিচারাধীন মোট মামলার সংখ্যা ৩৬ লাখ ৪০ হাজার ৬৩৯টি (সূত্র : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০)। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্রের ভাষ্যমতে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের বিচারিক ও সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৪৭টি। ২০২০ সালের ৩১ মার্চ দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৩৭ লাখ ৪২ হাজার। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় মামলাজট বেড়েই চলেছে।

এভাবে চলতে থাকলে আদালতের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে যাবে। আদালত মানুষের শেষ ভরসার আশ্রয়স্থল। মামলাজটের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ২০১৭-২০২২ সাল পর্যন্ত কৌশলগত পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে, বিচার ব্যবস্থার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঝুলে থাকা বিচারাধীন মামলা। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে সুপ্রিম কোর্ট মামলাজট নিরসনে দেশের সবনি¤œ আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে ৫ বছরের অধিক পুরনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয় এবং প্রতিটি আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পুরনো মামলা নিষ্পত্তির তালিকা সুপ্রিম কোর্টে পাঠাতে বলা হয়। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে মামলাজট না কমে উল্টো সুপারসনিক গতিতে বেড়ে চলছে।

অপরাধীর শাস্তি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চূড়ান্ত বিচার হওয়ার আগেই কাউকে অপরাধী তকমা দিয়ে বছরের পর বছর ধরে আটক রাখা জুলুম। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় নির্দোষ মানুষকেও জেলখানায় বন্দীজীবন কাটাতে হয়। জেলখানার জীবন কত কষ্টের তা ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। যাঁরা জেলখানার বন্দী তারা জানেন চার দেয়ালের ভেতরের অক্সিজেন আর মুক্ত বাতাসের অক্সিজেন এক নয়! এটা অত্যন্ত অমানবিক। তাঁরা ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। তাদের আর্তনাদ হাওয়ায় ভাসছে। ন্যায়বিচার কারও দয়া দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়; বরং মানুষের নাগরিক অধিকার। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য মানুষ আদালতের দারস্থ হয়। কিন্তু বিচারক সংকটে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য বিচারক মাত্র একজন। ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিচারকের অপর্যাপ্ততাকে মামলাজটের জন্য দায়ী করে বলেন, ‘বাংলাদেশে ১০ লাখ মানুষের সেবায় যেখানে ১০ জন বিচারক সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ১০৭ জন, কানাডায় ৭৫ জন, ইংল্যান্ডে ৫১ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১ জন এবং ভারতে ১৮ জন। বিচারক সংকটের কারণে অসংখ্য বিচারপ্রার্থী যথাসময়ে বিচার পাচ্ছে না। দেশে ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে, বাড়ছে মামলাজট। সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

তবে সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। মামলাজটে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে, তার একটি পরিসংখ্যান ড. আবুল বারাকাত তাঁর বই বাংলাদেশের ভূমি মামলার রাজনৈতিক অর্থনীতি: বিশাল এক জাতীয় অপচয়ের কতকথা’য় তুলে ধরেছেন। গ্রন্থের ভূমিকায় দেওয়ানী এবং ভূমি মামলার’ ক্ষয়-ক্ষতির কিছুটা ধারণা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে দেশে প্রায় ১২ কোটি মানুষ ভূমি মামলা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। মামলাধীন জমির পরিমাণ ২৩.৫ লাখ একর যা মোট জমির এক চতুর্থাংশ। মামলা মোকাবিলার জন্য ব্যয়িত অর্থের মোট পরিমাণ বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের ব্যয়ের চেয়ে বেশি। মামলায় জর্জরিত পরিবারগুলোর সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতির মোট পরিমাণ বছরে প্রায় ১১ দশমিক ৫১৯ কোটি টাকা। যা সত্যিই উদ্বেগজনক। একটি ফৌজদারী মামলা শেষ হয়। দেওয়ানী মামলা বংশপরস্পরায় চলে, কিন্তু সমাপ্তি হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এডিআরের মাধ্যমে মামলাজট কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা সময়ের দাবী। দেওয়ানী মামলার সাথে পাল্লা দিয়ে ফৌজদারী মামলা বাড়ছে। হাইকোর্টের বারান্দায় চক্কর দিলে অজ¯্র মানুষের মলিন মুখ দেখা যায়। তাঁরা অনেকে গায়েবী মামলায় আগাম জামিনের জন্য এসেছেন।

একটি দেশে আইনের শাসন সামগ্রিকভাবে কার্যকর করতে হলে দেশের তিনটি খুঁটি প্রশাসন, সংসদ ও বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হয়। এই তিনটি খুঁটি নড়বড়ে হলে অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মামলাজট বাড়লে আমাদের অসুবিধা কোথায়? আমাদের অসুবিধা হলো বিবেক অনবরত ক্রন্দন করে। অধিকাংশ বিচারপ্রার্থী মামলার খরচ যোগাড় করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেকে জমানো সঞ্চয় শেষ করে দিয়েছে। মামলাজট বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ নিম্নরূপ : মামলার তদন্ত রিপোর্ট প্রদানে দেরি হওয়া, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, সাক্ষী গ্রহণে বিলম্ব, দীর্ঘ সময় নিয়ে শুনানি, বার বার সময়ের আবেদন ও মুলতবির আবেদন, মামলার অনুপাতে বিচারক ও বেঞ্চ সংকট, অযথা রাজনৈতিক মামলা, অজ্ঞাত আসামী, গায়েবী মামলা, একশ্রেণীর পুলিশের অতি উৎসাহী মনোভাব, ইচ্ছাকৃতভাবে মামলা জিইয়ে রাখা, গোষ্ঠীগত স্বার্থ চিন্তা ও দুর্বল বিচার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।

মামলাজট কমানোর স্বার্থে দেশের প্রতিটি থানা ও জেলা পর্যায়ে একজন যোগ্য নীতিবান অবসরপ্রাপ্ত জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে। এব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহল চিন্তা ভাবনা করতে পারেন। ২৪ ঘন্টায় যতজন আসামী গ্রেফতার হবে তাদেরকে হয় আদালতে নতুবা মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। এটি করতে পারলে মামলাজট কিছুটা হলেও কমবে। এর বাইরে বিচার ব্যবস্থা ও ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার, গ্রাম পর্যায়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির প্রসার বাড়ানো, বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো, আদালতের অবকাঠামো ও জনবল বাড়ানো প্রয়োজন, যেন দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা যায়। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র বিচারপ্রার্থীদের ন্যায্যবিচার যথাসময়ে নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা করবে, এমনটিই জাতির প্রত্যাশা।

https://dailysangram.info/post/524870