১৮ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৭:৩২

নিয়োগে শামুকগতি বেকাররা নিরাশ

অনার্স শেষ করেই ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বাপেক্স) ‘সহকারী ব্যবস্থাপক (সাধারণ)’ পদে আবেদন করেছিলেন সুরভী খানম। এরপর মাস্টার্সের পাট চুকিয়ে সুরভী বিয়ে করে এখন কন্যাসন্তানের মা। ভুলেই গিয়েছিলেন বাপেক্সে আবেদনের কথা। ২০২২ সালের জুলাইয়ে ৭ বছর পর আচকা লিখিত পরীক্ষার প্রবেশপত্র যায় তাঁর গ্রামের বাড়ির ঠিকানায়। ঢাকায় এসে সেই পরীক্ষায় অংশও নেন তিনি। এরপর লিখিত পরীক্ষার ফলের আর খোঁজ নেননি সুরভী। বাপেক্স অফিসে গিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি এ লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে, তবে মৌখিক পরীক্ষা কবে হবে তা এখনও অজানা।

সুরভী খানমের মতো অনেকেই সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ার এমন গতিহীন ঘূর্ণিতে পড়ে হাঁপিয়ে উঠছেন। খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বারবার তাগাদা দিয়েও সরকারি নিয়োগে গতি আনতে পারছে না। পড়াশোনা শেষ করে সবাই সরকারি চাকরির পেছনেই ছোটেন। একদিকে সীমিত পদের কারণে তুমুল প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সময় ক্ষেপণে নিরাশ চাকরিপ্রত্যাশীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়োগ কার্যক্রমে শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনাগ্রহ, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ, দুর্নীতি এবং মামলাসংক্রান্ত কারণে সরকারি নিয়োগে এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

নিরাশার মধ্যেও আশার খবর হলো– বিসিএসের গতি বাড়াতে এবং নিয়োগের সময় কমিয়ে আনতে গত ১১ মে সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি) নতুন চার সদস্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
শীর্ষে খাদ্য অধিদপ্তর

নিয়োগে ধীরগতির ক্ষেত্রে বদনাম কামানোর শীর্ষে রয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। অনেকে এ সরকারি প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়োগে ‘দীর্ঘসূত্রতা এবং দুর্নীতির বিষবৃক্ষ’ হিসেবে উদাহরণ টানেন। সম্প্রতি এ অধিদপ্তরের নিয়োগসংক্রান্ত দুর্নীতির কারণে এক যুগ্ম সচিবকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়।

খাদ্য অধিদপ্তরের ১৩তম গ্রেডের উপপরিদর্শক পদের চূড়ান্ত ফলের অপেক্ষায় আছেন মাসুদ হাসান। অধিদপ্তর এ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে। লিখিত পরীক্ষা হয় ২০২১ সালের নভেম্বরে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার চার বছর পর মৌখিক পরীক্ষা হয় ২০২২ সালের জুনে। এখানেই শেষ নয়। মৌখিক পরীক্ষার পর চলে গেছে আরও ১১ মাস, এরপরও খাদ্য অধিদপ্তর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতে পারেনি। অধিদপ্তর-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগও উঠেছিল। হামিদুল ইসলাম নামের এক প্রার্থী সমকালকে বলেন, ভালো পরীক্ষা দিয়েছি, তবে পরীক্ষার পর ফল দিতে এত দেরি হওয়ায় সন্দেহ জাগে আসলে চাকরি হবে কিনা। কারণ, আমার মেধার পরীক্ষা ছাড়া অন্য কিছু বিনিয়োগ করে চাকরি নেওয়ার ক্ষমতা নেই।

ডাক অধিদপ্তরের উপজেলা পোস্টমাস্টার এবং পরিদর্শকসহ মোট ছয় পদে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আবেদন চাওয়া হয়। ২০২২ সালের জুনে ‘পোস্টমাস্টার’ পদের লিখিত এবং নভেম্বরে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ছয় মাস হতে চললেও অপেক্ষায় থাকা চাকরিপ্রার্থীরা জানেন না কবে প্রকাশ হবে ফল। অন্যদিকে আবেদনের দেড় বছর পার হতে চললেও পরিদর্শক পদের লিখিত পরীক্ষা এখনও হয়নি। কবে হবে তাও কেউ জানে না।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টাফ অফিসার এবং স্টেশন অফিসার ১২তম গ্রেডের এ দুই পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। এমসিকিউ এবং লিখিত পরীক্ষা হয়েছে যথাক্রমে সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে। এর মধ্যে স্টাফ অফিসারের লিখিত পরীক্ষার ফল হলেও মৌখিক কবে হবে সেই অপেক্ষায় দিন গুনছেন চাকরিপ্রার্থীরা। অন্যদিকে স্টেশন অফিসারের লিখিত ফলই এখনও প্রকাশ হয়নি, তাই মৌখিক পরীক্ষা বহুদূর।

খালি পদ ৩,৫৮,১২৫
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি চাকরির পদসংখ্যা ১৯ লাখ ১৩ হাজার ৫২টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে নতুন নিয়োগ দেওয়ার মতো পদ খালি আছে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির ৪৩ হাজার ৩৩৬টি, দ্বিতীয় শ্রেণির ৪০ হাজার ৫৬১, তৃতীয় শ্রেণির ১ লাখ ৫১ হাজার ৫৪৮ এবং চতুর্থ শ্রেণির ১ লাখ ২২ হাজার ৬৮০টি পদ শূন্য আছে। গত ২ সেপ্টেম্বর বিসিএস ছাড়া বিভিন্ন ক্যাটাগরির শূন্য পদ পূরণ করতে নির্দেশ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে বিসিএসে নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএসসি থেকে প্রায় প্রতি বছরই শূন্য পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে ৩ থেকে ৪ বছর সময় লেগে যাচ্ছে। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সম্প্রতি সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি বিভিন্ন নিয়োগ কার্যক্রম দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজে উচ্চ শিক্ষা শেষ করে চার বছর ধরে চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছেন মাসুদ হাসান। একাধিক সরকারি চাকরির লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আছেন। তবে মাস-বছর পার হলেও ফল আর বেরোচ্ছে না। নিজের হতাশার কথা জানাতে গিয়ে মাসুদ সমকালকে বলেন, যদি পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ হয় তাহলে কিছুটা সময় লাগলেও বোঝা যায়, তবে অন্য দপ্তরগুলোতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর কবে কখন কী হবে– তা ধারণাও করা যায় না। বেকারদের এ এক অন্যরকম যন্ত্রণা।

চাকরি পেয়েও পোড়ে কপাল
একজন দপ্তর প্রধানের দুর্নীতির কারণে সম্প্রতি ৭০ প্রার্থী ‘সোনার হরিণ’ হাতে পেয়েও হারিয়েছিলেন। ঘটনাটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রামের (সিপিপি)। সেখানে আট পদে ১০৯ জন নিয়োগের ক্ষেত্রে ৩৬ জনের নম্বর জালিয়াতি করে নিয়োগ কমিটি। আর এ কাজে নেতৃত্ব দেন সিপিপি পরিচালক আহমাদুল হক। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের তদন্তেই সেটা প্রমাণিত হয়। শেষমেশ অনিয়মের অভিযোগে নিয়োগটি বাতিল করে মন্ত্রণালয়। এতে দুর্নীতির বাইরে থাকা অন্তত ৭০ প্রার্থী সঠিক পথে চাকরি পেয়েও নিয়োগ বাতিল হওয়ায় কপাল পোড়ে। অথচ বহাল তবিয়তে আছেন অভিযুক্ত আহমাদুল হক।

বিসিএসের জট কমাতে উদ্যোগ
বিসিএসের গতি বাড়াতে ও নিয়োগের সময় কমিয়ে আনতে পিএসসির সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ করার আইন পাস করে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় পিএসসিতে নতুন চার সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিএসসির এক কর্মকর্তা বলেন, এখন ৪১তম বিসিএসের ভাইভা চলছে। সামনে ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএসের ভাইভা শুরু হবে। সদস্যরা সবাই ভাইভা বোর্ডে থাকেন। তাই একটি ভাইভা চলার সময় আর কোনো ভাইভা নেওয়া যায় না। নতুন সদস্য নিয়োগ হওয়ায় ভাইভা নেওয়ার পরিধি বাড়বে। সব মিলিয়ে বিসিএসে গতি আসবে।

পিএসসির সাবেক এক চেয়ারম্যান ও একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কমিশনে বেশি সদস্য আসা মানে কাজে গতি আসা। কমিশনের সদস্য বাড়লে ভাইভার বেশি বোর্ড হবে। ভাইভা গতিশীল হবে।


দেরি হয় কেন
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি নিয়োগে দীর্ঘ সময় লাগার বড় একটি কারণ দপ্তর বা সংস্থার প্রধানরা নিজেদের চাকরির সময়ে হয় নিয়োগ শেষ করতে চান না, না হয় নিয়োগ দিতে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে সাবেক এক দপ্তরপ্রধান (বর্তমানে সচিব) নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, বেশিরভাগ দপ্তর-সংস্থার প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান অতিরিক্ত সচিবরা। এখান থেকে যাঁরা সচিব হওয়ার আশায় থাকেন, তাঁরা নিয়োগ সংক্রান্ত কাজ শেষ করতে চান না। কারণ, এ সময় অনেক মন্ত্রী ও সচিবের তদবির থাকে। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তর-সংস্থায় কর্মরত অন্য কর্মকর্তারাও নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতে চান। এতে সবাইকে খুশি করা যায় না। ফলে ভবিষ্যতে সচিব হওয়ার পথে সমস্যা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, যেসব দপ্তর-সংস্থার প্রধান বুঝতে পারেন, তিনি আর সচিব হতে পারবেন না, তখন নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় আগ্রহ দেখান। আর এর নেপথ্যে উৎসাহ জোগায় বাড়তি আয়ের হাতছানি। এসব বিষয় যখন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে যায় তখন আদালতে মামলাসহ বিভিন্ন কারণে নিয়োগ আটকে যায়।

সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্বে থাকার সময় তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে ত্রুটিমুক্ত নিয়োগ দিয়ে সাধারণের কাছে প্রশংসা কুড়ালেও ক্ষমতাবানদের চক্ষুশূল হয়ে ভিন্ন আদলে শাস্তিও পেয়েছেন। নিয়োগ জটিলতার বিষয়ে তাঁর মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি একেক প্রতিষ্ঠানের একেক ধরনের নিয়োগ বিধিমালা। এসব অনুসরণ করে নিয়োগ হতে একটু সময় লাগে, এটা বাস্তবতা। তবে একটি নিয়োগ তো ৮-১০ বছর ধরে চলতে পারে না। তিনি বলেন, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরও কোনো চাকরি পরীক্ষার ফল বছরের পর বছর ঝুলে থাকা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সরাসরি অনেক কিছুই বলা যায় না, একটু ঘুরিয়ে বলি, সব শেষ হওয়ার যখন কোনো নিয়োগ পরীক্ষার ফল ঝুলিয়ে রাখা হয়, তখন সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।

এক প্রশ্নের জবাবে sকবীর জানান, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিয়োগ এড়িয়ে চলতে চান, এটাও সত্য। তবে আমি বলব, এমনটা করা উচিত নয়। আমি দায়িত্বে থাকার সময় সব ধরনের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক তদবির-চাপ উপেক্ষা করে ফল প্রকাশ করেছি। একজন কর্মকর্তা সৎ ও দক্ষ হলে তিনি কেন ভয় পাবেন?

প্রতিমন্ত্রী যা বললেন
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, সরকারি নিয়োগে একটু সময় লাগে, এটা সত্য। এর মধ্যে করোনাকাল যাওয়ায় সেটা আরও বেশি সময় নিয়েছে। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি থেকে মোটামুটি স্বাভাবিক হওয়া শুরু করতেই জনপ্রশাসন থেকে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরগুলোকে নিয়োগ কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেসব নিয়োগে মামলা সংক্রান্ত ঝামেলা নেই, সেগুলো দ্রুত করতে প্রয়োজনে আবারও নির্দেশনা পাঠাব।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সময়ের বাধ্যবাধকতা নেই, এটা ঠিক আছে। সময় বেঁধে দিলে আবার নতুন জটিলতা তৈরি হয় কিনা, সেটাও ভেবে দেখতে হবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2305173146