১৮ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৭:১৬

নিউজপ্রিন্টে পাঠ্যবই মুদ্রণের নীলনকশা

আগামী বছরও নিম্নমানের পাঠ্যবই মুদ্রণ ও সরবরাহের নীলনকশা চলছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) যে দামে পাঠ্যবই ছাপাতে চায়, তার চেয়ে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ কম দামে দর দিয়েছেন মুদ্রাকররা। এ কারণেই এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ইতোমধ্যে প্রাথমিকের তিনটি এবং মাধ্যমিকের দু’টি দরপত্রের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকের প্রাক্কলিত (যে দরে বই ছাপাতে চায় এনসিটিবি) দরের চেয়ে গড়ে ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ কম ডাকা হয়েছে।

আর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের দর দেওয়া হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দরে সাদা কাগজে দূরের কথা, ভালোমানের নিউজপ্রিন্টেও বই ছাপানো সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে হয় চাহিদার কম বই সরবরাহ করে মুদ্রাকররা লোকসান পোষাবে। নইলে ‘ডি’ ক্যাটাগরির বা একেবারে নিম্নমানের বইয়ে বই ছাপবে। চলতি বছরও অনেকে এই একই কাজ করেছে। আর এই দুটি কাজ করতে হলে যথাসময়ে বই সরবরাহ করবে না তারা। কেননা, হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে তা ছাড়পত্র পাবে না। তাই এবারের মতোই ফেব্রুয়ারি-মার্চে চলে যেতে পারে বই সরবরাহ। এ ছাড়া মুদ্রাকররা এবারের মতো পছন্দের মান তদারককারী বা ‘ইন্সপেকশন কোম্পানি’ নিয়োগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কেননা, পকেটের প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের বইও ছাড়পত্র দেয়। কিন্তু এসব অপকর্মের জন্য বিপাকে পড়তে পারে সরকার। কেননা, প্রায় প্রতিটি ঘরেই শিক্ষার্থী আছে। তাই ১ জানুয়ারি এবং মানসম্মত বই না গেলে তা নির্বাচনের বছরে ভোটে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘বেশ কম দরে দরপত্র দাখিল হওয়ার ঘটনায় আমরাও উদ্বিগ্ন। ইতোমধ্যে এ নিয়ে বোর্ডসভায় এক সভা আলোচনা হয়েছে। এখন সরকারি ক্রয় আইন (পিপিআর) অনুযায়ী পুনঃদরপত্র দেওয়া, ব্যাখ্যা তলবসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া যায়। তবে পদক্ষেপ যা-ই নেওয়া হবে, তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আলোচনা করে নির্ধারণ করা হবে।’

আর এনসিটিবি সচিব নাজমা আখতার যুগান্তরকে বলেন, কাজ পাওয়ার জন্য মুদ্রাকররা প্রতিযোগিতা করে এবারও প্রচণ্ড দরপতন ঘটিয়েছেন। আসলে গত বছর পার পেয়ে যাওয়ায় এবার এই ধরনের কর্মকাণ্ডে ঝোঁকা মুদ্রাকরের সংখ্যা বেড়েছে। নির্বাচনের বছরে যে দর পাওয়া গেছে, তা কেবল উদ্বেগজনকই নয়, সন্দেহজনক বটে। কেননা, নিম্নমানের আর নিউজপ্রিন্টে বই দিলে তা জনমনে সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিষয়টি ইতোমধ্যে মৌখিকভাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে অবহিত করা হয়েছে।

জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রাথমিকের প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি এবং প্রাক-প্রাথমিক স্তরের দরপত্র নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিকের গত ৮ মে ষষ্ঠ এবং ১৬ মে সপ্তম শ্রেণির দরপত্র নেওয়া হয়। মাধ্যমিকের এই বই ৭০ জিএসএম (কাগজের পুরত্ব) ও ৮০ শতাংশ উজ্জ্বলতার সাদা কাগজে ছাপতে হবে। এনসিটিবি এই বই প্রতি ফর্মা ৩ টাকা ১০ পয়সা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু মুদ্রাকররা ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের দর দিয়েছে ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৮০ পয়সার মধ্যে। আর সপ্তম শ্রেণির বইয়ের দর দিয়েছে ১ টাকা ৮০ থেকে ৮৫ পয়সা প্রতি ফর্মা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে রিম প্রতি ১৭শ’ থেকে ১৮৫০ টাকা করে কাজ নিয়েছেন তারা। অন্যদিকে বর্তমানে উল্লিখিত মানের সাদা কাগজের দরই আছে বাজারে প্রতি মেট্রিক টন ১ লাখ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। সাধারণত যখন পাঠ্যবই আর নোট-গাইড ছাপানোর সময় আসে তখন বা বছর শেষে কাগজের দাম বেড়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ভালো মানের নিউজ প্রিন্টেরই দাম আছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা মেট্রিক টন। বছরের শেষের দিকে এই দর ৮০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই হিসাবে নিউজপ্রিন্টেরই বর্তমানে প্রতি রিমের দাম আছে সাড়ে ১১শ টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য মুদ্রণ সামগ্রীর দাম পড়বে ২২০ টাকা, বাইন্ডিং খরচ দেড়শ টাকা, কভারে ১১২ টাকা, ৫০ টাকা পরিবহণ খরচ এবং ৭ শতাংশ সরকারি ট্যাক্স। এসব হিসাবে উৎপাদন খরচ যা আসে তাতে এনসিটিবির কাঙ্ক্ষিত মানে বই উৎপাদন হবে কি না সেটি বড় প্রশ্ন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নয়াবাজারকেন্দ্রিক কাগজের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী বিসমিল্লাহ পেপার ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. ইসমাইল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অসম প্রতিযোগিতা করতে গিয়েই মুদ্রাকররা এমন অস্বাভাবিক দর দিয়েছেন। বর্তমানে নিউজপ্রিন্টের দর আছে বাজারে ৭০ হাজার টাকা। সামনের দিকে দর আরও বাড়বে। তাই তারা নিউজপ্রিন্টেও এই দরে নেওয়া কাজে বই দিতে পারবে কি না সন্দেহ।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, গত বছরও কিছু মুদ্রাকর নিউজপ্রিন্টে বই মুদ্রণ করেছেন। তারা বিচারের মুখোমুখি হয়নি। তাই এবারও একই কাজ করতে পারবেন ও পার পাবেন-এমন নিশ্চয়তা থেকেই হয়তো কম দর দিয়েছেন তারা। এখন শর্ষের ভেতরই ভূত আছে কি না বা কারা এই নিশ্চয়তা দিল সেটি বের করা জরুরি।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, চলতি বছর এনসিটিবির বিতরণ ও প্রশাসন শাখা ইন্সপেকশন কোম্পানির সঙ্গে মিলে জালিয়াতি করেছে। প্রথমত, একই ব্যক্তির দুই প্রতিষ্ঠানে সরবরাহের আগের ও পরের মান তদারকির কাজ দিয়েছে। যে কারণে আগে আজান দিয়ে নিম্নমানের ও নিউজপ্রিন্টে ছাপানো বইয়ের ছাড়পত্র দিয়েছে। তাই পরে তারাই যখন মান পুনঃযাচাইয়ের কাজে গেছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই নিম্নমানের বই সরবরাহকারীদের রক্ষা করেছে। অন্যদিকে একই ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানকে এই কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে এনসিটিবির দুই ব্যক্তি মূল ভূমিকা পালন করেছেন বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে ‘র’ আদ্যক্ষরের একজন এক বছর এনসিটিবিতে চাকরি করেই গাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক বনে গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এনসিটিবিরই অন্য কর্মকর্তারা এই ব্যক্তির ও তার স্ত্রীর নামের ব্যাংক হিসাব এবং গাড়ি-ফ্ল্যাটের অনুসন্ধান চেয়েছেন। পাশাপাশি উল্লিখিত ইন্সপেকশন কোম্পানির ব্যাপারেও অনুসন্ধান চেয়েছেন। একটি সূত্র জানায়, যারা কম দামে কাজ নিয়েছে, তারা একই এবারও একই প্রতিষ্ঠানকে মান তদারকির কাজে আনার তৎপরতা শুরু করেছে। সেই আশা থেকেই গত বছরের মতো পার পাওয়ার ধান্দায় কম দামে কাজ নিয়েছে। এতে শিশুদের হাতে যাবে নিম্নমানের বই।

জানতে চাইলে এনসিটিবি সচিব নাজমা আখতার বলেন, আসলে ইন্সপেকশন কোম্পানি দুটিকে কাজ দেওয়ার পর আমরা জানতে পেরেছি যে, একই ব্যক্তির বা দুই ভাইয়েরই দুই প্রতিষ্ঠান। আবার এক ভাই আরেক ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কিন্তু ঠিকানা, ট্রেড লাইসেন্সসহ আলাদা কাগজপত্র থাকায় কমিটি হয়তো ধরতে পারেনি। তবে তাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব করা হবে। পাশাপাশি বিষয়টি তদন্ত করা যায় কি না তাও কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/675783