১৮ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৭:০৮

মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা

পেঁয়াজের ঝাঁঝ বাড়ছেই। মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা। প্রকৃত দাম পায়নি প্রান্তিক চাষিরাও। একমাসের ব্যবধানে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম হয়েছে দ্বিগুণ। এক মাস আগেও এক কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০ টাকা। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলছে, বাজারে এখন দেশি ও আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজের দর ৬০ থেকে ৭০ টাকা । এমন পরিস্থিতিতে বাজার ফিরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন ক্রেতারা।

কৃষকদের স্বার্থ বিবেচনায় এতোদিন পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছিলো। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে শিগগিরই পেঁয়াজ আমদানির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে। সরকারের এমন ঘোষণায় গত দু দিন ধরে ঊর্ধ্বমুখী বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। অর্থাৎ পেঁয়াজ গতকালও ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

আড়াই বছর আগে প্রকাশিত প্রমোটিং অ্যাগ্রিফুড সেক্টর ট্রান্সফরমেশন ইন বাংলাদেশ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাংলাদেশে কৃষিপণ্যগুলোর মধ্যে পেঁয়াজের বাজারেই অস্থিতিশীলতা দেখা যায় সবচেয়ে বেশি।

দেশে পেঁয়াজের যে আবাদ হয়েছে তাতে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। এ কারণে প্রতিদিন পণ্যটির দাম বাড়ছে। দেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়, তা দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ হওয়ার নয়, এরপর আবার আমদানিও বন্ধ। এসব কারণে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। কিন্তু কৃষিমন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরে পেঁয়াজের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে না পারলেও ২৫ লাখ টনের কাছাকাছি উৎপন্ন হয়েছে। আর দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৬-২৭ লাখ টন। চাহিদা এবং উৎপাদনের সাথে কোন মিল নেই। এ কারণে দেশের পরিসংখ্যানে বড় ধরনের গোঁজামিল রয়েছে।

পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, পেঁয়াজের দামটা বেশি বেড়ে যাচ্ছে। এত বাড়ার কারণ নাই। লাভেরও তো একটা সীমা থাকবে। এখন কৃষকরা পাচ্ছে না, কোন লেভেলে বাড়ছে, দুই-চার দিনের মধ্যেই আমরা জানাবো।

ফরিদপুরের কৃষক আমীর মোল্লা চলতি বছর ২ একর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করে পেয়েছিলেন ১২০ মনের মতো। তিনি তার আক্ষেপের কথা জানিয়ে বলেছেন, যখন পেঁয়াজ ঘরে তুলেছি তখন পেঁয়াজ বিক্রি করছি ৭০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা মণ। আমাদের তো রাখার জায়গা নেই। বাড়িতে রাখলে পেঁয়াজ পচে যায়। তাই পানির দামে বিক্রি করতে হয়েছে, পেঁয়াজের আবাদ করলাম, কিন্তু দাম পেলাম না।

নওগাঁর আরেক কৃষক ইদ্রিস জানান, গতবার কৃষি অফিস থেকে সার-বীজ দিয়েছিলো, আমি পেঁয়াজ আবাদ করেছিলাম। পেঁয়াজ তোলার পর বাজারে কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তাই এবার আর পেঁয়াজের আবাদ করি নাই।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, যেকোন কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে আমরা জানি যে, হারভেস্টের পরে যখন সাপ্লাই বেড়ে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই দাম কমা শুরু হয়। কিন্তু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেই পণ্যের আবার দাম বাড়তে থাকে।

তিনি আরও বলেন, পেঁয়াজ যে সময় হারভেস্ট করা হয় সেই সময়টা পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রা ও অর্জনটার কথা বলা হয়। কিন্তু পেঁয়াজ এমন একটা পণ্য, যেটা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ওজন হারায়। ওজন হারানোর ফলে যেটা হয়, যে লক্ষ্যমাত্রা, যে হিসাবটা দেয়া হয় সেটা থাকে না।

দেশে কেউ কী পেঁয়াজ মজুদ করে রেখে দাম বাড়িয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকা শহরের কোন ব্যবসায়ীর পেঁয়াজ মজুদ করার সুযোগ নেই। এই পেঁয়াজ মজুদ করতে অনেক জায়গার প্রয়োজন হয়। তবে মফস্বল শহরগুলোতে কিছু কিছু ব্যবসায়ী পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য চাঁঙ্কি বানিয়ে সংরক্ষণ করতে পারে। তাদের কিছু পেঁয়াজ মজুদ করার সম্ভাবনা থাকে।

গত বছর দেশের পেঁয়াজ নিয়ে কোন ধরনের অস্থিরতা ছিল না। কৃষকরাও লাভবান হয়েছে। কিন্তু এবছর পেঁয়াজ ভালো উৎপাদন হলেও হঠাৎ করে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এক মাস আগেও এক কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০ টাকা। পেয়াজ এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা। এক মাসে দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এতে করে বাজারে নতুন করে পেঁয়াজের অস্থিরতা শুরু হয়। এটা নিয়ে সরকারের মন্ত্রীরা কথা বললেও কোনভাবেই দাম কমছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, যদি দাম না কমে তাহলে অভিযান চালানো হবে। প্রয়োজনে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়া হবে। সরকারের এমন ঘোষণায় ৮০ টাকা বাজার স্থিতি থাকলেও এর থেকে আর কোনভাবেই কমছে না।

সরকার আসলে কোন পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে? তেলের বাজার এবং চিনির বাজারে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এতে করে ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। জানা গেছে, গত দু’মাস আগেই কাঁচা পেঁয়াজ বিক্রি হয়ে গেছে। কৃষক সংরক্ষণের অভাবে কাচা পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছে। কারণ পেঁয়াজ একটি পচনশীল পণ্য। আর এটি সংরক্ষণের জন্য অনেক জায়গা লাগে যা অধিকাংশ কৃষকের নেই। এ কারণেই কম দামে প্রান্তিক কৃষক পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

আর মৌসুমে কম দামে অর্থাৎ ২০ টাকা কেজি করে বিক্রি করে কৃষক। আর পেঁয়াজ ক্রয় করে সংরক্ষণ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা সিন্ডিকেট করে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে। এতে করে বাজার অস্থির হয়ে উঠে। সরকার চাইলে ধান চাল এবং গমের মত পেঁয়াজও গুদামজাত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু সরকারের এমন কোন উদ্বেগ নেই। এতে করে পেঁয়াজের বাজার দীর্ঘ মেয়াদেও অস্থিরতা বিরাজ করতে পারে। তবে স্বল্প সময়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে এখনই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে কুরবানির ঈদকে সামনে রেখে পেঁয়াজের বাজার আরও অস্থির হতে পারে।

https://dailysangram.info/post/524825