১৮ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৭:০৬

পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরানোর উদ্যোগে ভাটা

রাজনৈতিক আসামীদের ফেরাতে ব্যাপক তোড়জোড়

বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী বাইরে বসেই দেশের আন্ডার ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সোর্সের মাধ্যমে তারা তাদের নেটওয়ার্ক সক্রিয় রেখেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অন্তত এক ডজনেরও বেশি শীর্ষ সন্ত্রাসী কয়েক দশক আগে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। দেশের বাইরে থাকলেও সরকারি অফিসের দরপত্র ছিনতাই ও হুমকি দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায়ের ঘটনায় প্রায়ই তাদের নাম শোনা যায়। এসব ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় অনেকে থানায় মামলা ও সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছেন।

অথচ এসব দাগি অপরাধীদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগে ভাটা পড়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। সচেতন ব্যক্তিদের অভিযোগ, রাজনৈতিক ভাবে পলাতক আসামীদের দেশে ফেরাতে যেভাবে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, একইভাবে ইন্টারপোলের মাধ্যমে এসব মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধীদেরকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।

২০০১ এর ২৬ ডিসেম্বর ঢাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করা পলাতক ও আলোচিত ২৩ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে তখনকার সরকার। তাদেরকে ধরিয়ে দিতে ঘোষণা করা হয়েছিল অর্থ পুরস্কার। এরপর সময় গিয়েছে তবে তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন অপরাধের তদন্ত করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে। ফলে অপরাধ করেও বহাল তবিয়তে রয়েছে অনেক অপরাধী। এসব কারণে ভুক্তভোগী অনেক পরিবার উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় পাড় করছে। জানা যায়, ২০০১ সালে তৈরি করা তালিকায় যে শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসীর নাম যুক্ত করা হয়েছিল; এদের মধ্যে ৮ জনকে ধরিয়ে দিতে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়।

সম্প্রতি হত্যা মামলার আসামী আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০১৮ সালের ৭ জুলাই রাজধানীর বনানীতে একটি বাড়িতে খুন হন পুলিশ বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান। তাকে জন্মদিনের নামে একটি পার্টিতে ডেকে হত্যা করা হয়। ১০ জুলাই গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার উলুখোলা এলাকায় রাস্তার পাশে একটি জঙ্গল থেকে মামুনের বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়। পরিচয় গোপন করার জন্য লাশে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে চেহারা বিকৃত করা হয়। লাশ উদ্ধারের পর তার ভাই জাহাঙ্গীর খান বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান আসামী রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। সম্প্রতি অস্ত্র আইনে করা মামলায় আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামের ১০ বছরের কারাদ-ের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান দিয়ে আলোচিত আরাভ খানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচনা এখন থিতিয়ে এসেছে বলে পুলিশের তৎপরতাও যেন কমছে। ইন্টারপোলের রেড নোটিসের পর তার অবস্থান এখন কোথায় তাও জানে না পুলিশ।

এছাড়াও ক্লু না থাকায় অনেক সময় চেষ্টা থাকার পরও এমন অনেক ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয় না বলে মন্তব্য পুলিশ কর্মকর্তাদের। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অপরাধ জগতে প্রতিনিয়ত নতুন মুখ দেখা যায়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অপরাধী শনাক্ত করতে হলে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরি। র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, তারা বিদেশে বাংলাদেশী সন্ত্রাসীদের ওপর নজরদারি করতে পারেন না। তাদেরকে সংশ্লিষ্ট দেশের সহায়তা নিতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, অনেক ক্ষেত্রেই দেশগুলো সহায়তা করতে খুব একটা আগ্রহী হয় না। এ ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম শর্ত হলো সন্ত্রাসীদের তালিকা হালনাগাদ করা। এতে নতুন অপরাধীদের চিহ্নিত করা সহজ হয়। অপরাধীদের হালনাগাদ তালিকা তৈরিতে রাজনৈতিক বিবেচনা বা প্রভাবশালী বলে ছাড় দেয়া হবে না।

আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা হলো- ১. সুব্রত বাইন, ২. খোরশেদ আলম রাসু, ৩. মোল্লা মাসুদ, ৪. আব্বাস ওরফে কিলার আব্বাস, ৫. আরমান, ৬. হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, ৭. কালা জাহাঙ্গীর, ৮. আব্দুল জব্বার মুন্না, ৯. শামীম আহম্মেদ ওরফে আগা শামীম, ১০. জাফর আহম্মেদ মানিক ওরফে মানিক, ১১. খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, ১২. সোহেল রানা চৌধুরী ওরফে ফ্রিডম সোহেল, ১৩. খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, ১৪. ইমাম হোসেন, ১৫. প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, ১৬. সাগর ওরফে টোকাই সাগর, ১৭. মশিউর রহমান কচি, ১৮. কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান, ১৯. সানজিদুল ইসলাম ইমন, ২০. জিসান ওরফে মন্টি কচি ও ২১. মশিউর রহমান। এ ছাড়া পিচ্চি হান্নান আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। আর গণপিটুনিতে নিহত হন আরেক সন্ত্রাসী আলাউদ্দিন।

শীর্ষ সন্ত্রাসীর ২৩ জনের মধ্যে পলাতক ছিলেন জিসানসহ ১৩ জন। এদের নামে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। এছাড়া কেউ জেলে আছে। ভারতেও অনেকে অবস্থান করছে বলে গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, আন্ডার ওয়ার্ল্ডের এই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা অনেকটা আড়ালে থেকে তারা তাদের নিজস্ব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। বাইরে থেকে তাদের গ্যাং পরিচালনা করছে। কেউ জামিনে মুক্ত হয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে ১ জন বন্দুক যুদ্ধে নিহত ও একজন গণপিটুনিতে মারা গেছে। ৮ জন বাংলাদেশের কারাগারে রয়েছে। বাকি ১২জন বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। আর জিসান দুবাইয়ে গ্রেফতার হলো।

পুলিশের সূত্রগুলো জানায়, ১৯৯৭ সালে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ২০০৯ সালের জুনে কাশিমপুর কারাগার-২ থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরপরই ওই সময় জেলগেটের সামনেই তাকে গ্রেফতার করে গাজীপুর জয়দেবপুর থানা পুলিশ। ২০১২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পায় বিকাশ। তার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ নেতা জরিফ, আগারগাঁওয়ে জোড়া খুনসহ পাঁচটি হত্যা মামলাসহ ১৬টি মামলা রয়েছে। তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়। বিকাশের ভাই শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে সপরিবারে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বসবাস করছে। প্রকাশের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের কালিহাতী এলাকায়। আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী তানভীরুল ইসলাম জয় বহুদিন থেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতায় অবস্থান করছে। কলকাতা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। পরে জামিনে ছাড়া পায়। জয়ের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। সানজিদুল ইসলাম ইমন রয়েছে কানাডায়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় সুব্রত বাইন। পরে আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে নেপালে পালায়। সুব্রত বাইনের গ্রামের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়ায়। ঢাকায় মগবাজারে থাকতেন তিনি। পুরস্কার ঘোষিত আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী আমিন রসুল সাগর টোকাই সাগর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে বলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়। টোকাই সাগর সন্দ্বীপ থানার বাউরিয়া গ্রামের আবুবকর সিদ্দিকের ছেলে। তার বর্তমান ঠিকানা ঢাকার গুলশানে। জাফর আহমেদ ওরফে মানিক ও ইমাম হোসেন কলকাতায় অবস্থান করছে দীর্ঘদিন ধরে। মানিক রাজধানীর উত্তর শাহাজানপুরের বাসিন্দা। ইমাম হোসেন ঢাকার মহাখালীর বাসিন্দা। আব্দুল জব্বার মুন্না অবস্থান করছে জার্মানিতে। মিরপুর এলাকার আরেক সন্ত্রাসী শাহাদাত হোসেনও এখন ভারতে অবস্থান করছে। ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর তানভীর জেল থেকে মুক্তি পায়। এরপর থেকে তানভীরও থাকেন কলকাতার বনগাঁও এলাকায়। সূত্র জানায়, হারিস আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে আছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে। সে বৃহত্তর মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করতো। শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গির, জব্বার মুন্নাও ভারতে পালিয়ে আছে বলে জানা যায়। কালা জাহাঙ্গীর গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার ধুনট থানায়। কামরুল হাসান হান্নান জার্মানি ও জাফর আহম্মেদ মানিক ওরফে মানিক ভারতের ত্রিপুরায় অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। জব্বার মুন্নার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণায়। ঢাকার রমনা থানার বাসিন্দা মোল্লা মাসুদ কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে কলকাতায় আছে বলে জানা যায়। শীর্ষ সন্ত্রাসী আমিন রসুল সাগর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। শামীম আহমেদ কানাডায় আছে কয়েক বছর ধরে। শামীম রাজধানীর কোতোয়ালী থানাধীন ড. শামসুদ্দিনের ছেলে।

অন্যদিকে ২০০৪ সালের টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এলাকা থেকে ফ্রিডম সোহেলকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে। ফ্রিডম সোহেল ফেনীর দাগনভূঁইয়া এলাকার বাসিন্দা। এছাড়াও সুইডেন আসলামও জেলে রয়েছে। ২০০৩ সালে ৩ জুন মোহাম্মদপুর থানার একটি মামলায় আত্মসমর্পণ করার পর পিচ্চি হেলালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পিচ্ছি হেলাল মতলব উত্তর থানার বাসিন্দা। ২০০৪ সালে ফ্রিডম রাসুকে ধানম-ি এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি রমনা এলাকার মনসুরের ছেলে। ২০০৫ সালের ৩ জুন ধানম-ি এলাকা থেকে আরমানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। আরমান বড় মগবাজার এলাকার বাসিন্দা। পুলিশ সূত্র জানা গেছে, কিলার আব্বাস জেলখানায় বন্দী আছে। তার বিরুদ্ধে ছয়টি হত্যাসহ ১০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। কিলার আব্বাস ঢাকার কাফরুল এলাকায় থাকতেন পুলিশ সূত্রে জানা যায়। অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী টিটনকে ঢাকা মহানগর পুলিশ ২০০৪ সালে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। টিটন ঢাকার হাজারীবাগ এলাকার বাসিন্দা। একই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি অ্যাডভোকেট বাবর এলাহী হত্যা মামলায় তার মৃত্যুদ- ঘোষণা করা হয়। এদিকে ২০০৪ সালের ২৬ জুন র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান মারা যায়। ২০০৩ সালের মার্চে হাতিরঝিল এলাকায় এক পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলী করে হত্যার পর পালাতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয় সন্ত্রাসী আলাউদ্দিন।

উল্লেখ্য, পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে জিসান আহমেদ ওরফে মন্টিকে ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর দুবাই থেকে গ্রেফতার করা হয়। ইন্টারপোল বাংলাদেশ শাখার ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত জিসানের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ রয়েছে। তার নামে রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছে ইন্টারপোলও। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।

https://dailysangram.info/post/524822