২৩ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৮:৫৯

বর্ষার আগেই ডুবছে চট্টগ্রাম

অপরিকল্পিত উন্নয়নের কুফল : খাল নালা জলাশয় ভরাট : দুর্ভোগে অর্ধ কোটি মানুষ : বিরূপ প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও উৎপাদনে

ঘন ঘন ডুবছে দেশের ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। তাও বর্ষা আসার অনেক আগেই রাস্তাঘাট তলিয়ে নগরবাসী চরম দুর্ভোগে পড়ছে। বৈশাখ মাসের শুরুতে অর্থাৎ গ্রীষ্মের গোড়ায় হঠাৎ বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতার এই ভয়াল চিত্র। রাস্তাঘাট-সড়ক, আবাসিক, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে খাল বা নদীর মতো পানি থৈ থৈ করে। সামনে ভরা বর্ষায় ঘোর বিপদের আশঙ্কা মাথায় নিয়ে সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন গুজরান করছে সমগ্র চট্টগ্রামবাসী। গত চৈত্র মাস থেকে এ পর্যন্ত পর পর তিন দফায় ডুবেছে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিশাল এলাকা। গত শুক্রবার সকালে প্রথম দুই ঘণ্টায় ৩২ মিলিমিটার (১২ ঘণ্টায় ৮৫ মি.মি.) বৃষ্টিতেই ডুবে যায় নগরী। গতকাল (শনিবার) সকাল থেকে প্রথমে রোদ পরে আকাশ মেঘলা, এরপর দুপুর থেকে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়ে দমকা ও ঝড়ো হাওয়ার সাথে বজ্রসহ হালকা থেকে মাঝারি বর্ষণে হাঁটু সমান কাদা-পানিতে ফের প্লাবিত হয় নগরীর বেশকিছু এলাকা। আরও দু’দিন বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে বন্দর-ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্বের ধারক ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মহানগরীর ৫৫ লাখ মানুষ পানিবদ্ধতায় নানামুখী ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
নগর পরিকল্পনাবিদগণ একবাক্যে চট্টগ্রামের পানিবদ্ধতার সমস্যাকে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, খেয়াল-খুশি ও সমন্বয়হীনভাবে নগরায়নের কুফলকে দায়ী করেছেন। শুধু তাই নয়; স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি চট্টগ্রাম সফরকালে পতেঙ্গা বোট ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বন্দরনগরীতে যথেচ্ছ ও অপরিকল্পিত এবং ধীরগতিতে উন্নয়ন কর্মকান্ডে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সর্বস্তরের মানুষের মুখে মুখে ফুটে উঠেছে একই ক্ষোভ আর অসন্তোষ। গতকালও ঘুরেফিরে উঠে আসে শুক্রবারের বর্ষণে কোমর সমান পানিতে নগরী ফের তলিয়ে যাওয়া এবং এ কারণে চরম জনদুর্ভোগের কথাগুলো। অনেককেই কঠোর সমালোচনার ভাষায় এখানে-সেখানে বলতে শোনা গেছে, চট্টগ্রামবাসী এ মুহূর্তে পানিবদ্ধতার সমস্যা থেকে পরিত্রাণ চায়। অথচ মুক্তির উপায় দেখছে না। নগরীর কেন্দ্রস্থল আউটার স্টেডিয়ামে বিতর্কিত সুইমিংপুল বিলাসিতা হচ্ছে। এ নিয়ে হচ্ছে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের মারামারি, রক্তারক্তিও। আর অল্পক্ষণ বৃষ্টিপাত হলেই নগরীর মূল সড়ক, রাস্তা-ঘাটই এখন সুইমিং পুলের রূপ লাভ করছে!
এদিকে নগর পরিকল্পনাবিদগণ অদূর ভবিষ্যতে চট্টগ্রামে পানিবদ্ধতা বিস্তৃত হওয়ার শঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছেন, পানিবদ্ধতার সমস্যা দিন দিন আরও ব্যাপক এলাকাজুড়ে বাড়বে। বর্তমান মেয়রের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিগগিরই এ সংকটের পরিকল্পিত এবং সকল সরকারি সংস্থা ও বিভাগ একত্রিতভাবে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাধান করা জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তা না হলে চট্টগ্রাম বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। তখন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়-বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, বর্তমান কল-কারখানাগুলোতে উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়বে। আটকে যাবে কর্মসংস্থানের সুযোগও। কেননা বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে চট্টগ্রামের পানিবদ্ধতা সমস্যার সাথে অর্থনীতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম-চট্টগ্রামের সভাপতি ও ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইডিইউ) ভিসি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান গতকাল এ বিষয়ে দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, চট্টগ্রামে ক্রমবর্ধমান পানিবদ্ধতার সমস্যা সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কিন্তু এর কোনো সুরাহার দিকে আমরা যেতে পারছি না। দেখা যাচ্ছে, নদী, খাল, নালা-নর্দমা, পুকুর, জলাশয় যে যেভাবে পারছে নির্বিচারে ভরাট করে দখল করে নিচ্ছে। এ কারণে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হচ্ছে। পানি অপসারিত না হয়ে আটকে থাকছে। এতে করে সৃষ্টি হচ্ছে পানিবদ্ধতা। এটা বন্ধ করা সিডিএ’র দায়িত্ব হলেও তারা সেটা করতে পারছে না। দখল-ভরাটে প্রভাবশালীরাও জড়িত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আমরা পরিকল্পিতভাবে নগরীকে গড়ে তুলতে পারছি না। আগেও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কিন্তু তা পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। ভবিষ্যতের প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। সামনে যে আবারও পরিকল্পনা নেয়া হবে (ড্যাপ) তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বর্ষা আসার অনেক আগেই চট্টগ্রাম যেভাবে ঘন ঘন ডুবছে সে প্রসঙ্গে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, অতিবর্ষণ ও কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ভরা জোয়ারের পানির চাপে পানি নামতে পারছে না। এতে করে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, পানিবদ্ধতা নগরীর পুরনো একটি সমস্যা। আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। তবে আমি চেষ্টা করছি যাতে নগরবাসীকে পানিবদ্ধতা সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়া যায়। তবে এটি ছোট-খাটো সমস্যা নয়। এর সুরাহার জন্য আমি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়েছি। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের বিষয়টি এ মাসে চূড়ান্ত হবে।
গত কয়েক বছর ধরে যে পরিচিত চালচিত্র তা হলো, ভরা বর্ষার আগে প্রাক-বর্ষায় এবং বর্ষাত্তোর বর্ষণে অল্পক্ষণ বৃষ্টি হলেই বন্দরনগরীর অনেক জায়গা হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে প্লাবিত হয়। ভরা বর্ষায় তা অবর্ণনীয় দুর্দশার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। নিচু এলাকাগুলোর পানিবদ্ধতার চিত্র খুবই নাজুক। সেখানে হাজার হাজার বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, গুদাম, আড়ত, বাজার, মসজিদ, রাস্তাঘাট, অলিগলি কাদাপানিতে তলিয়ে যায়। খাল-নালা উপচে গিয়ে বাড়িঘর, দোকানপাটের ভেতরের কাদাপানি, বালির স্তূপ আর ময়লা-আবর্জনার ঢিবি সৃষ্টি হয়। আর জঞ্জাল অপসারণেই মানুষকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। গতকাল রাত পর্যন্ত অনেক জায়গায় পানি আটকে থাকে। লোকজনকে তা সরাতে গিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়। অনেক বাড়ি-ঘরে চুলা জ্বলেনি। বিশেষ করে যখন-তখন পানিবদ্ধতায় বন্দরনগরীর বাকলিয়া, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, মুরাদপুর, প্রবর্তক মোড়, বহদ্দারহাট, শোলকবহর, ষোলশহর, নাসিরাবাদ, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, রাজাখালী, আগ্রাবাদ, সাগরিকা, হালিশহর, পতেঙ্গার অনেক এলাকা প্লাবিত হয়। বৃষ্টি চলাকালীন ভরা জোয়ারের সময় হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে।
পানিবদ্ধতা ঘন ঘন হওয়ায় এতে নগরীর অধিকাংশ সড়ক, রাস্তাঘাট খানাখন্দে ভরে গেছে। চাক্তাই খাতুনগঞ্জসহ ব্যবসায়িক এলাকাগুলোতে পণ্য ভর্তি শত শত গুদাম, আড়ত, দোকানপাট কাদাপানিতে সয়লাব হয়ে যায়। নগরীতে পাহাড়-টিলা কাটা মাটি ও বালি এবং অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজের বালি-মাটিতে রাস্তাঘাট, নালা-নর্দমা ভরাট হয়ে গেছে। শিল্পের কাঁচামাল মজুদ রাখা গুদাম এবং বেসরকারি আইসিডিও পানিতে ভাসছে। এতে কোটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে প্রত্যেকবারের পানিবদ্ধতার কারণে। নগরবাসী চান পানিবদ্ধতা সংকটের আশু সমাধান। তবে পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাব এবং সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পরিবেশ অধিদপ্তর আর ওয়াসার মধ্যে রশি টানাটানি, সমন্বয়হীনতার কারণে পানিবদ্ধতার সমস্যা যেই তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
বন্দরে সংকেত বহাল
উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। এ অবস্থায় উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩নং স্থানীয় সতর্ক সংকেত বহাল রাখা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম-সিলেটে পাহাড় ধসের সতর্কতা
বজ্রঝড়ের ঘনঘটা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও গত শুক্রবার থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভ‚মি ধসের আশঙ্কা রয়েছে। পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে গতকাল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়-টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসরত লোকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেসব স্থানে সতর্কতা প্রচার করা হচ্ছে।
বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে
সন্ধ্যায় আবহাওয়ার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানা গেছে, লঘুচাপের একটি বর্ধিতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও এর সংলগ্ন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। যার বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এটির প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। একই কারণে বাংলাদেশ ও আশপাশ অঞ্চলে মেঘ-বৃষ্টির আবহ বিরাজ করছে। এ অবস্থা আরও এক বা দু’দিন অব্যাহত থাকতে পারে। গতকাল দেশের অধিকাংশ জায়গায় বৃষ্টিপাতে বর্ষাকালীন আমেজ সৃষ্টি হয়।
গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে আজ (রোববার) সন্ধ্যা অবধি পরবর্তী ২৪ ঘন্টার আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘন্টায় আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। এর বর্ধিত ৫ দিনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। এদিকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে দিনাজপুরে ১০৪ মিলিমিটার। এ সময় ঢাকায় ২৫ মিমি, ময়মনসিংহে ৭৩ মিমি, চট্টগ্রামে ১৬ মিমি, কুমিল্লায় ৩৩ মিমি, নোয়াখালীতে ৭২ মিমি, সিলেটে ২২ মিমি, রাজশাহীতে ২৩ মিমি, রংপুরে ৩৬ মিমি, খুলনায় ১৬ মিমি, বরিশালে ৭৬ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/76263/