১৭ মে ২০২৩, বুধবার, ২:৪৭

আয় বাড়াতে আগামী বাজেটে সর্বস্তরে চাপবে অতিরিক্ত করের বোঝা

আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি করার কারণে সরকারকে বেশ কিছু কঠিন শর্ত পালন করতে হবে। তারপরও যে কোনো মূল্যে আইএমএফ’র ঋণ পেতে চায় সরকার। আর এসব শর্তের প্রতিফলন আগামী বাজেটে থাকবে। যেমন- রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) নিতে হবে। এটা করতে হলে গণহারে যে করছাড় দেয়া আছে, তা তুলে দিতে হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে দেয়া কর অবকাশ সুবিধা তুলে দিতে কঠোর হতে হবে। এটা করা হলে দেশীয় শিল্পগুলো কমবেশি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। তাছাড়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্য যখন নানান চাপের মধ্যে তখন বাড়তি করের বোঝা চাপবে তাদের ওপর। এর সঙ্গে সব স্তরের করের বোঝা বাড়বে। কারণ, আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে আসছে অর্থবছরে অন্তত ৬৫ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় করতে হবে। এটা করতে কমবেশি ব্যক্তিশ্রেণির কর যেমন বাড়বে, তেমনি সব স্তরেই করের চাপ পড়বে।

এদিকে বৈশ্বিক সংকট সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। একদিকে স্বস্তি দিতে গিয়ে অন্য দিকে টান পড়ছে। প্রতি মুহূর্তে খেয়াল রাখতে হচ্ছে আইএমএফের শর্ত; যেন কোনো অবস্থাতেই ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের বাকি কিস্তিগুলো আটকে না যায়। অর্থনীতিতে টানাপোড়েন, আইএমএফের নানা শর্ত আর জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার বড় বাজেট দিতে যাচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে নতুন বাজেটের আকার বাড়ছে ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে পাঁচ লাখ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি এবং দেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশের সমান। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়বে ৬০ হাজার কোটি টাকা। এনবি আরের লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি এনবি আরবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা আর করবহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাজেটঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা, অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি কমিয়ে আনা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা- আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এসব শর্ত পূরণের বিষয় বিবেচনায় রাখা হবে নতুন বাজেটে। আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ অনুমোদনের সঙ্গে এসব শর্ত সম্পর্কিত। আইএমএফ প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার দিয়েছে। বাকি অর্থ সমান ছয় কিস্তিতে দেবে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে কম সুদের এই ঋণের বাকি কিস্তিগুলো নির্বিঘেœ পাওয়ার জন্য নতুন বাজেটে আইএমএফের শর্তের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সাধারণের সংকট আমলে না নিয়ে, তাদের সাথে কথা না বলে শুধু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে এগোলে বৈষম্য আরও বাড়বে। যেসব দেশে আইএমএফের কর্মসূচি চালু আছে সে সব দেশে বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছে থেকে ৫৭০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশ বেশ কিছু সংস্কারমূলক কর্মসূচি শুরু করেছে। এমনিতেই বাংলাদেশে বৈষম্য বেশি, আইএমএফ-এর কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে বৈষম্য আরও বাড়াবে। আইএমএফ কর্মসূচিভুক্ত দেশে বাজেট অনাথ থাকে। আর আইএমএফ বাজেটের পালক পিতা হয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতে আগামী তিন অর্থবছরে বাংলাদেশকে রাজস্ব হিসেবে দুই লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে বিদ্যমান সারচার্জ ৫ থেকে ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। ফলে ধনীদের দিতে হতে পারে আরও উচ্চ কর। রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, সারচার্জ যৌক্তিক হারে বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। বর্তমান কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রাজস্ব আদায় যখন কঠিন হয়ে পড়েছে, তখন ধনীদের কাছ থেকেও সহযোগিতা প্রয়োজন। এছাড়া আরও সহজ করা হতে পারে সারচার্জ কাঠামোর প্রস্তাব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধনীরা বেশি কর দেবে, কেননা তারা বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কিছু নাগরিক সুবিধা পেতে সব ধরনের নাগরিককেই বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয়।

রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, ধনী করদাতাদের আয়করের ওপর এখন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ বিদ্যমান। ব্যক্তি করদাতার সম্পদসীমা ১০ থেকে ২০ কোটি টাকার মধ্যে থাকলে তাকে ২০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। আর ২০ থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদের ওপর ৩০ শতাংশ এবং ৫০ কোটি টাকার ওপরে সম্পদের জন্য সারচার্জ দিতে হয় ৩৫ শতাংশ। এছাড়া তিন থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদ থাকলে, নিজ নামে একাধিক গাড়ি থাকলে বা সিটি করপোরেশন এলাকায় ৮ হাজার বর্গফুটের অধিক আয়তনের আবাসিক সম্পত্তি থাকলে ন্যূনতম ১০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। সারচার্জ হচ্ছে এক ধরনের ‘অতিরিক্ত’ কর। ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের ক্ষেত্রে কারও নির্দিষ্ট সীমার বেশি সম্পদ থাকলে নিয়মিত কর দেওয়ার সঙ্গে ‘বাড়তি’ এই সারচার্জও পরিশোধ করতে হয়। নিট সম্পদের ওপর ভিত্তি করে এটি ধার্য করা হয়। একে ‘সম্পদজনিত’ করও বলা হয়। রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১৫ হাজার ব্যক্তি করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন। যার পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা।

এমনিতেই রাজস্ব আয়ে নাজুক অবস্থা চলছে। চলতি অর্থবছরের আট মাসেই (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ঘাটতি প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। একদিকে রাজস্ব আদায় বাড়ছে না, অন্যদিকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দিতে হচ্ছে। জানা যায়, শুধু এনবিআরকেই আগামী অর্থবছরে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হচ্ছে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটা কঠিন হলেও এ পথেই হাঁটছে সরকার।

রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, আগামী বাজেটে বাড়তি কর আদায়ের নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গ্রামের মানুষকে করজালের আওতায় আনতে উন্নত দেশের মতো বিভিন্ন জেলায় কর এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন কর এজেন্টরা নতুন করদাতাদেরও সাহায্য করবে। ই-টিআইএন থাকা সত্ত্বেও যারা এখনো কর রিটার্ন জমা দেননি, তাদের রিটার্ন প্রস্তুত করতেও সহায়তা করবে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠকে এনবিআর কর্মকর্তারা এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে বাজেটের অর্থ বিলে ‘ইনকাম ট্যাক্স প্রিপেয়ারার (আইটিপি)’ নামে একটি নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যার খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে অর্থনীতির গবেষক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, প্রাক-বাজেট আলোচনায় আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি যে, বর্তমান এই কঠিন সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখার দিকেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের মানুষ সত্যিই কষ্টে আছে। তাদের আগে স্বস্তি দিতে হবে। তারপর জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকে তাকাতে হবে। সেইসঙ্গে রিজার্ভ যাতে আর না কমে সেজন্য রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও কম সুদের বিদেশি ঋণ বাড়াতে বাজেটে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর দিকে।

এদিকে অনেক সমালোচনার পরেও গত বাজেটে সরকার পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে ফিরিয়ে আনতে মাত্র ৭ শতাংশ করের মাধ্যমে ‘অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি’র বিধান প্রথমবারের মতো অর্থ আইনে যুক্ত করে। যদিও সরকারের এই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এই প্রক্রিয়ায় বিদেশ থেকে কোনো অর্থ আসেনি। অন্যদিকে, অর্থ আইন-২০২২ এ অপ্রদর্শিত সম্পদ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন না করলে সমপরিমাণ জরিমানারও বিধান করা হয়। এক্ষেত্রেও কোনো বৈদেশিক সম্পদ দেশে ফেরত আসেনি। ফলে, আগামী বাজেটে সাধারণ ক্ষমায় বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে ফেরানোর সুযোগ থাকছে না। পাশাপাশি রিটার্নে অপ্রদর্শিত অফশোর সম্পদ বা বিদেশে স্থাবর সম্পদ দেখানোর সুযোগ বাতিল করা হচ্ছে। এ উদ্যোগের ফলে গত বাজেটোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল টাকা ফেরত আসবে বলে যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন তা কাজে আসেনি।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জানান, এ ধরনের বৈষম্যমূলক নীতিতে সৎ করদাতা নিরুৎসাহিত হয়েছেন। টাকা যে ফেরত আসবে না সেটা সব মহল থেকেই বলা হয়েছিল। তবে এই সুযোগে দেশ থেকে টাকা পাচার উল্টো বাড়লো কি না সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। বিগত কয়েক মাসে অপ্রাতিষ্ঠানিক মার্কেটে ডলারের দাম ও ব্যাংকে ডলারের দামের পার্থক্য দেখলে বিষয়টা কিছুটা আঁচ করা যেতে পারে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, টাকা যে ফেরত আসবে না সেটা সিপিডি থেকে আগেও বলা হয়েছে। এটা প্রমাণিত। যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে, তাদের সম্পদ দেশেও রয়েছে। অনেক দেশ ট্যাক্স রিকভারি পদ্ধতিতে পাচারকারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারে। আমরাও সেটা করে দেখতে পারি। পাশাপাশি অর্থপাচার রোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

https://dailysangram.info/post/524726