২৩ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৮:৫৬

হাওরে পানি দূষণ ও মড়কের রহস্য কি

হাওরে পানি দূষণ এবং মাছ ও হাঁসের মড়কের কারণ এখন পর্যন্ত উদঘাটিত হয়নি। বিষয়টি রহস্য ঘেরা বলে দাবী করছে হাওর অঞ্চলের সচেতন মানুষ। দুই সপ্তাহ পরেও এ বিপর্যয়ের রহস্য উদঘাটন না হওয়াতে এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বিপর্যয়ের কারণ জানাতে পারেননি সরকারী বিশেষজ্ঞরাও। এ পর্যন্ত যেসব বিশেষজ্ঞ দল সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন হাওরের পানি ও নমুনা সংগ্রহ করেছেন তাদের মধ্যে সরকারী প্রতিনিধিরা বলছেন, ধান, ধানগাছ ও ঘাস পচে পানি দূষণ হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ধান পচে এমোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টির ফলে পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়াতে মাছ মরে গেছে। তবে স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েক বছর পর পরই অকাল বন্যায় হাওরের ধান তলিয়ে যায়। কিন্তু এমনটি হয়নি। বরং পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান মাছের খাবারের চাহিদা পূরণ করে এবং বেশি বেশি মাছ উৎপন্ন হয় হাওরে। তাঁদের মতে, গত দেড় শ’ বছরের মধ্যে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তাঁরা বলছেন, কাঁচা কিংবা পাকা ধানসহ এর আগেও হাওরের ধান পানিতে তলিয়ে গেছে, কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। 

ধর্মপাশার হাওর এলাকার গ্রাম রাজাপুর, ওই গ্রামের ৭৬ বছর বয়সের একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ কৃষক রমজান আলী। তিনি জানান, ১৯৭৪ সালে চৈত্রমাসে সুনামগঞ্জের সকল হাওরের কাঁচা ধান এবং আধা-পাকা ধান অকাল বন্যায় পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। কৃষকেরা এক মুঠো ধানও ঘরে তোলতে পারেনি। ওই বছর প্রচুর মাছ উৎপন্ন হয়েছিল। এলাকার গরীব মানুষেরা মাছ বিক্রি করে সারা বছর জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হয়েছিল। রমজান আলী জানান, তিনি তার দাদার কাছে শুনেছেন এর আগে ১৯৫৮ সালে এবং ১৯৬২ সালেও এভাবে অকাল বন্যায় হাওরের ধানী জমি চৈত্রমাসের শুরুতে তলিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পানি দূষিত হয়ে মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, তখন অবশ্য হাওর এলাকায় এভাবে হাঁসের খামার বা হাঁস চাষ হতো না।
সুনামগঞ্জের একাধিক প্রবীণ ব্যক্তি দাবী করেছেন, পানিতে হয়তো যে কোন ভাবেই হোক মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিক মিশে গেছে। অথবা উজান থেকে আসা পাহাড়ী বা প্রতিবেশী দেশের পানিতে ছড়িয়ে পড়া কোন ধরনের উচ্চ মাত্রার রাসায়নিক মিশ্রিত পানি হাওরের পানিতে মিশে একাকার হয়ে গেছে। বিষয়টি নিরেপক্ষভাবে তদন্ত হওয়ার দাবী করেছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম নওশাদ আলমের মতে, হাওরে এর আগেও অনেকবার বাঁধ ভেঙে ফসল ডুবেছে। তাই বলে এত ব্যাপক হারে মাছের মড়ক লাগেনি। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। মারাত্মক কোনো বিষক্রিয়া না হলে এভাবে মাছের মড়ক লাগতে পারে না বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘গত ১৮ ফেব্রæয়ারি ভারতের দ্য শিলং টাইমস খবর ছেপেছে যে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে ইউরেনিয়াম ও কয়লাখনি উত্তোলনের কারণে একটি নদীতে মাছ মরে যাচ্ছে। আমি মনে করি, ঢলের সঙ্গে সেই দূষিত পানি এসে হাওর-নদীর পানি দূষিত করছে। তাঁর মতে, এভাবে কখনো পানিদূষণ হয়নি কিংবা মাছ ও জলজ প্রাণী মারা যায়নি। তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।
এদিকে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের একটি প্রতিনিধি দল সুনামগঞ্জের হাওরের পানি ও বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেছে। পানিতে কি ধরনের বিষাক্ত পদার্থ আছে তা পরীক্ষ-নিরীক্ষা করার জন্য এসব নমুনা সংগ্রহ করেছে। অকাল বন্যায় ধান পচে সৃষ্ট গ্যাসে সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে মাছ ও জলজপ্রাণীর অস্বাভাবিক মড়কের কারণ খতিয়ে দেখতে গতকাল শনিবার সকাল থেকেই জেলার বিভিন্ন হাওরে পানি-মরা মাছসহ জলজ জীব ও উদ্ভিদ প্রজাতির পরীক্ষ-নিরীক্ষা করা শুরু করেছেন তারা। এর আগে গত শুক্রবার হাওরের পানি ও মাছ পরীক্ষা করে গেছে বাংলাদেশ মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল। হাওরে মাছ ও হাঁসের মড়কের জন্য ফসলের মাঠে ব্যবহার করা কীটনাশকও একটি কারণ বলে মনে করছে এই গবেষক দল।
তারা বলছেন, বন্যার পানি ফসলের মাঠ ডুবিয়ে দেয়ায় কীটনাশক ও এসিড ছড়িয়ে পড়েছে।
হাওরের পানি পরীক্ষা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আজমল হোসেন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের জানান, অন্যান্য এলাকা থেকেও এসিডিটি ও কীটনাশক পানির সঙ্গে আসতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। যার ফলে মাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। ধানের পচা দুর্গন্ধ থেকে মানুষের শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে এটা সাময়িক।
দলটি আরও জানিয়েছে, জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ আধার মাছের অভয়াশ্রম বিশ্ব ঐতিহ্য টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ ও জলজ প্রাণী মারা গেলেও অন্য হাওরের তুলনায় তা কম। তবে হাওরের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার আহŸান জানিয়েছেন তারা।
উল্লেখ্য, অসময়ে তলিয়ে যাওয়া হাওরগুলোর মধ্যে কয়েকটি হাওরে মাছ মরে ভেসে ওঠে। হাওরে ধান পচে সৃষ্ট বিষাক্ত গ্যাসে মাছে মড়ক লাগায় গত বৃহস্পতিবার থেকে সুনামগঞ্জের হাওরে আগামী এক সপ্তাহের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়।
সরকারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁচা ধান পচে এই গন্ধ হচ্ছে। আর ধান পচার কারণে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমেছে এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে মাছ মরে যাচ্ছে।
শুধু কাঁচা ধান পচে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, নাকি অন্য কিছু? উৎসের সন্ধানে গত শুক্রবার সকালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সৈয়দ মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল হাওর এলাকায় এসেছে। দিনভর সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, মাটিয়ান হাওর ও খরচার হাওরের পানি, দূষিত হয়ে মারা যাওয়া মাছসহ বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে দলটি। ‘মাদার ফিশারিজ’ হিসেবে সংরক্ষিত টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের পাদদেশে। বিশেষজ্ঞ দল সেখানে কোনো মরা মাছের সন্ধান পায়নি। তবে টাঙ্গুয়ার হাওরের পাশে ফসলি হাওর হিসেবে পরিচিত তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওর ও খরচার হাওরে পানিদূষণ পাওয়া গেছে।
দূষণ ও গন্ধের উৎস মেঘালয়ের ইউরেনিয়াম ও কয়লাখনির বর্জ্য থেকে কি না, এর জবাবে সৈয়দ মেহেদী হাসান বলেন, ‘এটা এখন কোনোভাবেই বলা যাচ্ছে না। আমাদের সংগ্রহ করা নমুনা নিয়ে উচ্চতর পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। তারপর বলা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা মনে করছি, কাঁচা ধান পচে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভারী বৃষ্টি হলে দূষণের মাত্রা কমার সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) গবেষণায়ও এ রকম কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। সংস্থাটির মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ইউরেনিয়াম দূষণে মাছ মারা গেছে কি না, তা আণবিক শক্তি কমিশন ছাড়া আর কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না। তবে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যেসব তথ্যপ্রমাণ আছে, তাতে ইউরেনিয়াম দূষণের কোনো লক্ষণ পাইনি।
সুনামগঞ্জের হাওরে হাওরে ব্যাপক হারে মাছের মড়কের পর এখন শুরু হয়েছে হাঁসের মড়ক। দূষিত পানি ও পচা মাছ খেয়ে মরছে হাঁস। গতকাল কথা হয় ছয়জন হাঁসের খামারির সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার নূরপুর গ্রামের আজিজুল ইসলাম জানান, তাঁর ৮০০ হাঁসের মধ্যে ২০০, বুড়িস্থল গ্রামের আবদুল মুমিনের ৯৭০টির মধ্যে ২২০, ভৈষারপাড় গ্রামের কামাল হোসেনের ১ হাজার ১০টির মধ্যে ১৭৯, একই গ্রামের পবন মিয়ার ১২০০ হাঁসের মধ্যে ১৩৫, লালপুর গ্রামের নুরুল আমিনের ১ হাজার ৫০টি হাঁসের মধ্যে ৪৫০ এবং দোয়ারাবাজার উপজেলার আলী আকবরের ২ হাজার হাঁসের মধ্যে মারা গেছে ৬০০।
এদিকে বিএফআরআইয়ের একদল বিশেষজ্ঞ ১১টি হাওরের মাছ ও পানির নমুনা পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়া এবং অ্যামোনিয়া গ্যাস বেড়ে যাওয়ার কারণে হাওরে মাছ মরছে। বিএফআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা হাওরে মাছের মৃত্যু নিয়ে করা তাঁদের প্রাথমিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছেন। এতে বলা হয়েছে, পানির নমুনাগুলোতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে দশমিক শূন্য ১ থেকে দশমিক ৮ মিলিগ্রাম। সাধারণত নিরাপদ মাছ চাষের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৫-৮ মিলিগ্রাম থাকার কথা। নমুনায় কয়েকটি জায়গায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্যের কাছাকাছি ছিল। ওই পানিতে মাছের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। টানা কয়েক দিন পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্য থাকলে সেখানে মাছের মড়ক লেগে যায়।
বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক বলেন, গাছের পচনে অ্যামোনিয়া গ্যাসের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়াও মাছের মড়কের অন্যতম কারণ। নমুনায় পানিতে বিষাক্ত অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ছিল প্রতি লিটারে দশমিক ৪ থেকে দশমিক ৬ মিলিগ্রাম। সাধারণত পানিতে বিষাক্ত অ্যামোনিয়ামের পরিমাণ প্রতি লিটারে দশমিক শূন্য ২ মিলিগ্রামের বেশি থাকলে মাছের জন্য তা অসহনীয়।
জামালগঞ্জের হালির হাওরপাড়ের হরিণাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় বেহেলি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মুনু মিয়া জানান, ঝড়ের সময় বাতাসে দুর্গন্ধ পান তাঁরা। এতে তাঁর ঘরের দুই শিশু বমি করে দেয়। হাওরে পানি ঢুকে বদ্ধ অবস্থায় ছিল। তাই এত দিন বিষয়টি বোঝা যায়নি। ঝড়ের পরে মাছ মরে ভেসে ওঠায় এখন বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে।
জগন্নাথপুর উপজেলা হাওর উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আগে কখনো এ পরিস্থিতি হয়নি। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না দেখা দরকার। তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওরপাড়ের জামলাবাজ গ্রামের জেলে রমিজ উদ্দিন বলেন, মানুষের ধান গেছে, মাছ ও হাঁস মরছে। বসতবাড়িতে যে হারে দুর্গন্ধ, তাতে মনে হয় মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড হাওর অ্যাগ্রিকালচার বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ নূর হোসাইন মিয়া বলেন, প্রচুর বৃষ্টি হলে দুর্গন্ধ কিছুটা কমবে। তবে আমি আগেও বলেছি, সরকারের পক্ষ থেকে দ্রæত বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়ে পানিদূষণের প্রকৃত কারণ বের করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
দূষিত পানি ব্যবহার এবং আধা মরা মাছ খাওয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, দূষিত পানি ব্যবহারে মানুষের শরীরে নানা চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। সেই সঙ্গে যেহেতু এসব মাছ বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে, তাই এগুলো খাওয়া ঠিক হবে না।

https://www.dailyinqilab.com/article/76258/