১৪ মে ২০২৩, রবিবার, ২:২৮

বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদনে ধস, চরম দুর্ভোগে মানুষ

ঘূর্ণিঝড় মোকার প্রভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদনে ধস নেমেছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারাদেশের মানুষ। রাজধানী ঢাকাতেও বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি ভয়াবহ। এ অবস্থা আরও নাজুক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মোকার কারণে সৃষ্ট বিদ্যুৎ ও গ্যাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় মোকার আঘাত ভয়াবহ হবে এতে সন্দেহ নেই। ক্ষয়ক্ষতি না দেখে মেরামতে কতদিন লাগবে তা বলা মুশকিল। তবে বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতার পরিচয় দিয়ে আসছে। যথাসম্ভব প্রস্তুতিও আছে। ফলে দ্রুততম সময়ে সবকিছু স্বাভাবিক করার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হবে বলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ সূত্রে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাময়িক এই অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে গণমাধ্যমকে বলেছেন, অতিদ্রুত গ্যাস বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হবে। সূত্র জানিয়েছে, গত শুক্রবার রাত থেকেই আমদানি করা তরল গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।

তবে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন অব্যাহত আছে। এমনিতে বহু আগে থেকেই গ্যাসের ঘাটতি ব্যাপক। শুক্রবার থেকে আরও ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। ফলে গ্যাসচালিত অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। দেশে মোট বিদ্যুতের অর্ধেক উৎপাদন করা হয় গ্যাস দিয়ে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে ৫ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে সারাদেশে প্রমাণিত চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট। সেখানে উৎপাদন নেমে এসেছে সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াটে। অর্থাৎ ঘাটতি কমবেশি ৭ হাজার মেগাওয়াট। রাজধানী ঢাকাতেই গতকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় কয়েক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। শিল্পকারখানা, বাসাবাড়ি এবং সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সংকট আরও নাজুক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আমদানি করা এলএনজি প্রক্রিয়াজাত করা হয় কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে। এখানে সাগর উপকূলে এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। মোকার মূল টার্গেট বাংলাদেশের কক্সবাজার, উখিয়া, টেকনাফ, সেন্টমার্টিনসহ আশপাশ এলাকা। ফলে আজ রোববার হয়তো জানা যাবে মোকার আঘাতে কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হলো এই এলএনজি টার্মিনাল। এই ক্ষয়ক্ষতির ওপরই নির্ভর করবে কত দ্রুত এই টার্মিনাল মেরামত করা সম্ভব হবে। শুক্রবার থেকে দৈনিক গ্যাসের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬০ কোটি ঘনফুট। গত বৃহস্পতিবার পেট্রোবাংলা সরবারহ করেছে ২৮০ কোটি ঘনফুট ৷ শনিবার তা নেমে আসে ২২০ কোটি ঘনফুটে। শুধু দেশি ক্ষেত্রগুলোর গ্যাস দিয়ে চাহিদা মেটানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার।
রাজধানীর বিদ্যুৎ ও গ্যাস পরিস্থিতি

শনিবার রাজধানীতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় ছিল। রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জানিয়েছেন, শনিবার তাঁর এলাকায় সর্বোচ্চ ৪৮০ মেগাওয়াট লোডশেড করতে হয়েছে। ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাউসার আমীর আলী জানিয়েছেন, তাঁর এলাকায় ৩৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি জানিয়েছে, তাদের এলাকায় বিদ্যুতের ঘাটতি সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে।

রাজধানীর দক্ষিণ বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা জান্নাতুন নূর মেঘলা ফোনে সমকালকে জানান, গতকাল সারাদিন অন্তত চারবার বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করেছে। প্রত্যেকবার কমপক্ষে এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ ছিল না। সারাদিন গরমে প্রাণ হাঁসফাঁস অবস্থা। দুর্ভোগ থেকে কবে মুক্তি মিলবে জানতে চান তিনি।

মুগদা এলাকার গৃহিণী পূর্ণিমা বলেন, সারাদিন বিদ্যুৎ যাওয়া-আসার মধ্যে ছিল। বাচ্চারা গরমে অস্থির হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া গ্যাসও আসছিল অনেক কম। রান্নাবান্না করতে দেরি হয়েছে। শিশুদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেও সমস্যা হচ্ছে।

মিরপুর ১-এর বাসিন্দা তাহমিদ রহমান ইমন নামে এক ব্যক্তি জানান, সারাদিন বিদ্যুৎ ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে, গ্যাস খুব কম সময় ছিল। বাসার বুয়া ঠিক মতো রান্না করতে না পেরে চলে গেছে। গ্যাস না থাকার কারণে খাওয়া-দাওয়ায় কষ্ট হচ্ছে।

আজিমপুরের বাসিন্দা ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী শায়লা শিকদার জানান, সারাদিন গ্যাসের চাপ ছিল না। এজন্য ভাত রান্না করতেই দেড় ঘণ্টা সময় লেগেছে। এ ছাড়া সারাদিন বিদ্যুৎ অনেকবার যাওয়া-আসা করেছে। অনেক কষ্ট হয়েছে।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তায় অবস্থিত অল ইন ওয়ান সিএনজি স্টেশনের টেকনিশিয়ান ওয়ালিউর রহমান বলেন, মোকার কারণে গ্যাস না আসার নোটিশ পাইনি আমরা। কিন্তু আমাদের স্টেশনে গ্যাস নেই। অন্যদিকে, সারাদিনে বেশ কয়েকবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়েছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে অবস্থিত সিএনজি স্টেশনের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, লাইনে গ্যাস থাকলে আমরা দিতে পারব, না থাকলে তো দিতে পারব না। তবে আমাদের তেলের যথেষ্ট মজুত রয়েছে। অন্যদিকে, আজকে প্রায় সাত-আটবার বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করেছে। এ রকমই রাজধানীর চিত্র।

এদিকে গ্যাস সংকটে শনিবার সকালে গাজীপুর, সাভার ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয় চরমভাবে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় অনেক কারখানা চালু করাই সম্ভব হয়নি। ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোতেও একই অবস্থা। সিএনজি স্টেশনে গাড়ির দীর্ঘ সারি দেখা গেছে।

ঢাকা বিভাগে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা তিতাস শনিবার জানিয়েছে, এলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকায় রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করবে। এলএনজি সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত গ্যাসের স্বল্প চাপ থাকবে। এই দুর্ভোগ কত দিন চলবে, সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি তিতাস।

গ্যাস সংকটে চট্টগ্রাম, মেঘনাঘাট, হরিপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কয়েকটির উৎপাদন কমানো হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় মোকার কারণে সৃষ্ট দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে বলা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার নির্ভরযোগ্যতা বজায় রাখার স্বার্থে সব বিদ্যুৎ বিতরণ ইউটিলিটি, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং গ্রিড উপকেন্দ্রকে এনএলডিসির নির্দেশনা মেনে চলার জন্য পরামর্শ দিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি)। আবহাওয়া পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ও জ্বালানি সরবরাহ বাড়লে তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হবে।

পিডিবির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাঁরা দিনে ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পেতেন, এখন তা নেমে গেছে ৬০ থেকে ৭০ কোটি ঘনফুটে। তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এরপরও ৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো ঘাটতি রয়েছে। এখন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি।
পিডিবির সতর্কবার্তা

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) শনিবার জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় মোকার প্রভাবে বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটতে পারে। গাছ ভেঙে পড়ে বৈদ্যুতিক লাইন ও খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে গাছ সরানোসহ যান্ত্রিক ত্রুটি মেরামতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তারা আরও জানিয়েছে, বিদ্যুৎ প্রাণঘাতী। দুর্যোগে বিদ্যুতের ছেঁড়া তারের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ঝড় থেমে গেলেও গ্রাহকরা যেন কোনোভাবেই ছেঁড়া তার সরাতে না যান। বিদ্যুৎ কর্মীরাই ছেঁড়া তারের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পাশাপাশি বিদ্যুতের ছেঁড়া তার দেখামাত্র কাছের বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়েছে।

 

https://samakal.com/bangladesh/article/2305172451