১৩ মে ২০২৩, শনিবার, ১২:২৮

তুচ্ছ ঘটনায় খুনোখুনি বাড়ছে

রাজধানীতে তুচ্ছ ঘটনায় খুনোখুনির ঘটনা বাড়ছে। কিশোর গ্যাং কালচার বেপরোয়া হয়ে ওঠায় অস্থির হয়ে উঠেছে অপরাধ জগৎ। কথায় কথায় হামলা, মারধর, ছুরিকাঘাত চলে। বুধরার এমনই এক ঘটনায় প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে মো. তাজুল ইসলাম নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থী নিহত হয়। এ সময় সায়েম নামে আরও এক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়া দনিয়া কলেজের সামনে এ ঘটনা ঘটে। তাজুল দনিয়া এ কে স্কুল অ্যান্ড কলেজের চলমাল এসএসসি শিক্ষার্থী ছিলো।

গত ৯ই মার্চ হাইকোর্ট সংলগ্ন রাস্তায় ছুরিকাঘাতে এক যুবক নিহত হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে দুই পথচারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসক রাত সোয়া ৮টার দিকে একজনকে মৃত ঘোষণা করেন।

পথচারী সাকিল ও হৃদয় জানান, তারা হাইকোর্টের সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় দেখেন, ওই যুবক রাস্তার পাশ থেকে হেঁটে এসে একটি রিকশার সঙ্গে ধাক্কা খায়। তখন তারা অন্য একটি রিকশা করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে নিহত যুবকের সঙ্গে কি হয়েছে সে বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন তারা। নিহতের বুক ও পাঁজরসহ কয়েক জায়গায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এর আগে গাজীপুরে বাসায় ঢুকে কলেজছাত্রী রাবেয়া আক্তারকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন ঘাতক গৃহশিক্ষক সাইদুল ইসলাম। গ্রেপ্তার এড়াতে নিজের চুল ও দাড়ি কেটে ফেলেন সাইদুল। ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে সাইদুল ওই পরিবারের সকল সদস্যকে ৪-৫ মাস আরবি পড়িয়েছেন। এই সময়ে রাবেয়ার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে রাবেয়াকে মৌখিকভাবে সকলের অসম্মতিতে গোপনে বিয়ে করেন। বিষয়টি রাবেয়ার পরিবার জানার পর সাইদুলের বাসায় আসা বন্ধ করে দেন। সাইদুল রাবেয়াকে আর যেন উত্ত্যক্ত না করেন বলে শাসানো হয়। ২ মাস আগে থেকে সাইদুল রাবেয়াকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত এবং সামাজিকভাবে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে।

সমপ্রতি রাবেয়া ইউরোপের একটি দেশে স্কলারশিপে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সাইদুল পরিকল্পিতভাবে রাবেয়াকে হত্যা করতে ৭ই মে বিকালে শাল্লা বাজারের একটি দোকানে গরু কাটার একটি ছুরি অর্ডার দেন। ৬৫০ টাকার দিয়ে ছুরিটি ৮ই মে সন্ধ্যায় সংগ্রহ করেন। সাড়ে ৭টার দিকে সাইদুল রাবেয়াদের বাসায় যায়। রাবেয়া যে রুমে পড়াশোনা করছিল সেই রুমে প্রবেশ করে ওই ছুরি দিয়ে রাবেয়াকে এলোপাতাড়ি আঘাত করেন। রাবেয়ার চিৎকার শুনে অন্য রুমে থাকা রাবেয়ার মা এবং বোনেরা এগিয়ে এলে তাদেরকেও সাইদুল কুপিয়ে পালিয়ে যান। পরে রাবেয়ার বাবা এবং স্থানীয়রা প্রাথমিক ভাবে তাদেরকে গাজীপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে রাবেয়া মারা যায়।

এদিকে রাজধানীর ৫০টি থানায় চলতি বছেরের গত চার মাসে পুলিশের দেয়া তথ্য বলছে, খুন, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতি, অস্ত্র, মাদক, চোরাচালান, ধর্ষণ, নারী-শিশু নির্যাতন, সড়ক দুর্ঘটনাসহ অর্ধশত ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এসব অপরাধে বছরজুড়ে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ২০-৩০ হাজার মামলা হয়। সবচেয়ে অপরাধ বেশি হয় তেজগাঁও অঞ্চলে এবং কম রমনা বিভাগে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মামলার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ডিএমপি’র তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ডিএমপি’র ৫০টি থানা মিলে মামলা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৯টি। ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আট হাজার ৫০৩টি মামলা হয়েছে। ডিএমপি’র ওয়ারী বিভাগে ওয়ারী, ডেমরা, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া ও কদমতলী এ ছয়টি থানা। এখানে প্রায়ই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের ৩রা এপ্রিল ও ১৩ই মার্চ ডেমরা থানার আমুলিয়া মডেল টাউন এলাকায় দু’টি খুনের ঘটনা ঘটে। নিহত দু’জনই অটোচালক।

গত বছর ডিএমপিতে ১৭৩টি খুনের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৭টি ঘটে ওয়ারী বিভাগে। ৩১টি মিরপুর বিভাগে। এছাড়া মতিঝিল ও গুলশানে ২১টি করে, লালবাগ ও উত্তরা বিভাগে ১৭টি করে খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর রমনায় ১৬টি ও তেজগাঁওয়ে ১৩টি। চলতি ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৯ হাজার ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব মামলা নিষ্পত্তি ও অপরাধ দমন করতে গিয়ে ২০২২ সালে ৮৮ জন ও ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২২ জন পুলিশ হামলার শিকার হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে তেজগাঁও বিভাগে সবচেয়ে বেশি এক হাজার ৬৩১টি এবং রমনা বিভাগে সবচেয়ে কম ৬৬৬টি মামলা হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে সবচেয়ে বেশি ৭৮৪টি অস্ত্র-মাদক- চোরাচালান মামলা হয়েছে। এ বছরও দস্যুতা, ছিনতাই ও চুরিসহ অন্যান্য ঘটনায় বেশি মামলা হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, রাজধানীতে এলাকাভেদে অপরাধের বৈচিত্র্যতা দেখা যায়। সম্পর্ককেন্দ্রিক অপরাধ যেমন- মনোমালিন্য, ঝগড়া, মারামারি, পারিবারিক কলহ, বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির ঘটনা ঘটে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, রাজধানীতে বিভিন্ন সময়ে অপরাধের চিত্র বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। কোনো মাসে কম অপরাধ সংঘটিত হয়। কখনো আবার হঠাৎ করে খুন, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ডিএমপি’র সবগুলো থানাকে নিয়ে মাসিক অপরাধ সভার মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধের চিত্র তুলে ধরা হয়। যেসব এলাকায় অপরাধের মাত্রা বেশি হয় সংশ্লিষ্ট ওই থানায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করার পাশাপাশি পুলিশ পেট্রোলিং বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

https://mzamin.com/news.php?news=55197