১৩ মে ২০২৩, শনিবার, ১২:২০

মোখায় মহাবিপদ সঙ্কেত

উপকূলে সর্বোচ্চ ২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা

কাল রোববার ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানতে পারে স্থলভাগে। এটা হতে যাচ্ছে অতি প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ঘূর্ণিঝড়। মোখার প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে এবং নিচু এলাকায় পানি উঠে যেতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা বলছেন। তারা বলছেন, উপকূলীয় নিচু এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রায় পুরোটাই অস্থায়ীভাবে তলিয়ে যেতে পারে। সেখানে আশ্রয় নেয়ার জন্য কোনো ভবনের নিচতলাও নিরাপদ থাকবে না বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ। তিনি জেটিডব্লিউসিকে উদ্ধৃত করে বলেন, গতকাল সকাল ৯টায় ঘূর্ণিঝড়টির কারণে সমুদ্রে সৃষ্ট সর্বোচ্চ উচ্চতার ঢেউ ছিল ২৮ ফুট। মার্কিন নৌবাহিনী পরিচালিত জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারকে (জেটিডব্লিউসি) করে মোস্তফা কামাল বলেন, মোখার সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ২২১ কিলোমিটার।

উপকূলে উঠে আসার পর এর মূল কেন্দ্রটি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের দিকে যাবে। বাংলাদেশের কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলায় অপেক্ষাকৃত কম গতিসম্পন্ন বাতাসের ঝাপটা লাগতে পারে। গত বৃহস্পতিবারের চেয়ে গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় মোখা সামনের দিকে (বাংলাদেশ উপকূলের দিকে) এগিয়েছে প্রায় ২০০ কিলোমিটার। আজ শনিবার সামনের গিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গতি আগের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে।

আবহাওয়া অফিসের বুলেটিনে জানানো হয়েছে, মধ্য বঙ্গোপসাগর ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা (ইসিপি : ৯৮৩ এইচপিএ) উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি গতকাল দুপুর ১২টায় কক্সবাজার সমুদ্র বন্দর থেকে ৯৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এক হাজার পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা বন্দর থেকে ৯৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৯৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি ধীরে ধীরে আরো উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘনিভূত হতে পারে।

গতকাল শুক্রবার ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আবহাওয়া অধিদফতর। এতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় মোখার অগ্রসর হওয়ার প্যাটার্নের কারণে এর গতি বাড়ছে। এটি আগে ছিল সিডিইউ প্যাটার্নের কিন্তু পরিবর্তিত হয়ে এটি ব্যান্ড প্যাটার্নে রূপ নিয়েছে। এ কারণেই এর তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের নভেম্বরের পর থেকে এটাই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রথম ঘূর্ণিঝড়। দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গোপসাগরের পানি উত্তপ্ত হয়ে আসছে বলে এর গতিবেগ অন্যান্য ঝড়ের চেয়ে একটু বেশিই থাকবে। অন্যভাবে বলা যায় বঙ্গোপসাগরে মে মাসের ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ কিছু বেশিই থাকে।

আবহাওয়া গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেছেন, মোখা কক্সবাজার ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওপর দিয়ে আঘাত করলেও পুরো বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়বে। এটা হবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে।

তিন বন্দরে আট নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত : এগিয়ে আসছে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা। আর এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের তিন বন্দরে আট নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। বন্দর তিনটি হলো চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পায়রা। আর মংলা সমুদ্র বন্দরে আগের দেয়া ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত বহাল আছে। শুক্রবার রাত ৯টায় আবহাওয়া অধিদফতর বিশেষ বার্তায় এ ঘোষণা দেয়। বিকেলেই দেশের চার বন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সঙ্কেত উঠিয়ে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত দেখাতে বলে আবহাওয়া অধিদফতর। এরপর রাতে মহাবিপদ সঙ্কেত দেয়া হলো। আবহাওয়া অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: আজিজুর রহমান বলেন, মোখা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলমুখী। আর সে জন্যই ৮ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে তিন বন্দরকে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত নামিয়ে তার পরিবর্তে আট নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। মংলা সমুদ্রবন্দরকে চার নম্বর নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে।

উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং তাদের কাছের দ্বীপ ও চরগুলো আট নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের আওতায় থাকবে। ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ থেকে সাত ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

জিডিএসিএসের রেড অ্যালার্ট জারি : ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ নিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে দুর্যোগ সতর্কতাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ডিজাস্টার অ্যালার্ট অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন সিস্টেম (জিডিএসিএস)। সংস্থাটি এই মুহূর্তে বিশ্বে চলমান দুর্যোগগুলোর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় মোখাকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এটি অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উপকূলে আঘাত হানতে পারে। জিডিএসিএস হলো জাতিসঙ্ঘ ও ইউরোপীয় কমিশনের একটি সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক। এটা বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ মোকাবিলায় তথ্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে। গতকাল সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে এসব তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এ সময় বাতাসের গতি সর্বোচ্চ ২০৪ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠতে পারে। আর দুই মিটার (৬ ফুটের বেশি) পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।

খুলনায় ৪০৯ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত
খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনায় ঘূর্ণিঝড় মোখার ক্ষতি মোকাবেলায় ৪০৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এ ছাড়া ৬ হাজার ২৬০ জন স্বেচ্ছাসেবী, ১১৬টি মেডিক্যাল টিম, ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের আগেভাগেই প্রস্তুত করা হচ্ছে।
পর্যটক শূন্য কুয়াকাটা

কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা জানায়, গত কয়েক দিন ধরে ঘূর্ণিঝড় মোখার সংবাদের কারণে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে কুয়াকাটা। বেশির ভাগ হোটেল-মোটেলের রুম খালি রয়েছে। ফলে অলস সময় পার করছেন পর্যটন নির্ভর ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখাযায়, কুয়াকাটার সৈকতে পর্যটকদের পদচারণা একেবারেই কম। স্থানীয় জনসাধারণের উপস্থিতি কিছুটা লক্ষ করা গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্কে পর্যটকদের উপস্থিতি একদম শূন্যের কোটায় বলে জানান পর্যটন নির্ভর ব্যবসায়ীরা।

ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের আগমন ঘটাতে প্রথম সারির হোটেল থেকে শুরু করে বেশির ভাগ হোটেল মোটেলে পঞ্চাশ শতাংশ ছাড় দিলেও আসছে না কাক্সিক্ষত পর্যটক।

বরগুনায় ২৪টি স্থানের বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ
বরগুনা প্রতিনিধি জানায়, বরগুনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের ২২টি পোল্ডারের ২৪টি স্থানে আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। তাই এসব এলাকার অন্তত ৫০ হাজার বাসিন্দারা ঘূর্ণিঝড় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
এসব এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলে বেড়িবাঁধের দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করবে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বেড়িবাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দিয়ে লোকালয়ের পানি প্রবেশ রোখে জিও ব্যাগ প্রস্তুতি রাখা হয়েছে।

আতঙ্কে আমতলীর উপকূলবাসী
আমতলী (বরগুনা) সংবাদদাতা জানায়, ঘূর্ণিঝড় মোখার আতঙ্কে উপকূলীয় অঞ্চল আমতলী ও তালতলীর লক্ষাধিক মানুষ। ঝুঁকিতে বসবাস করছেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা। মোখা মোকাবেলায় দুই উপজেলায় ১৭৪টি সাইক্লোন শেল্টার এবং তিন হাজার ৩০০ জন সিপিপির স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উপকূলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাড়ে ৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবক
কক্সবাজার অফিস জানায়, ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র প্রভাবে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় নানা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে সাড়ে তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবক। যারা ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে পাহাড়ের ওপরে ও পাদদেশে যারা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে তারা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেবেন। এর জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের নিকটবর্তী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

সৈকতের পানিতে নামতে নিষেধাজ্ঞা : কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের পানিতে পর্যটকসহ সবাইকে নামতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। গতকাল বেলা ২টা ৪০ মিনিট থেকে ৩টা ১০ মিনিট পর্যন্ত মাঝারি মানের বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা রয়েছে। এরপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান জানিয়েছেন, মোখার প্রভাবে মাঝারি মানের এই বৃষ্টিপাত। তা থেমে থেমে আবারো হতে পারে।

শুক্রবার বিকেল ৪টার পর থেকে সৈকতে ঘোরাফেরা করা পর্যটকসহ কাউকেও পানিতে নামতে দিচ্ছে না সৈকতের নিরাপত্তায় নিয়োজিত লাইফ গার্ড, বিচকর্মী ও ট্যুরিস্ট পুলিশ।

এ দিকে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে দ্বীপ ছেড়ে টেকনাফ আসতে শুরু করেছেন। ট্রলারেযোগে দ্বীপের আতঙ্কিত এসব মানুষ টেকনাফ আসছে। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত দ্বীপের অনন্ত দুই শত পরিবারের দেড় হাজারের কাছাকাছি মানুষ টেকনাফ আসার তথ্য পাওয়া গেছে।

দ্বীপের জনপ্রতিনিধি খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, দ্বীপের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। স্কুল, হোটেল ও রিসোর্টগুলো আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করেছে প্রশাসন। সেন্টমার্টিন দ্বীপের ১০ হাজার বাসিন্দা। এরই মধ্য ট্রলারযোগে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ছেড়েছেন দেড় হাজারের মতো বাসিন্দা।
টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ চলাচল বন্ধ

উপকূলের দিকে ক্রমেই এগিয়ে আসতে থাকা ঘূর্ণিঝড় মোখা। শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টায় কক্সবাজারের এক হাজার কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে ছিল। কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৪নং সতর্কতা সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এমতাবস্থায় টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে টেকনাফ উপজেলা প্রশাসন।

উৎকণ্ঠায় উপকূলবাসী
ভোলা প্রতিনিধি জানান, শক্তি সঞ্চার করে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় মোখা। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন উপকূলের বাসিন্দারা। তবে দুর্যোগপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে আনতে এরই মধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। শুক্রবার সকাল থেকেই রেড ক্রিসেন্ট, সিপিপি ও কোস্টগার্ডের বেশ কয়েকটি দল মানুষকে সচেতন করতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ভোলার বিভিন্ন পয়েন্টে এ প্রচারণা চলছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে সতর্কতা জারি
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ঘূর্ণিঝড় মোখা ধেয়ে আসার খবরে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে আবহাওয়া অফিসের সতর্কসঙ্কেতের সাথে মিলিয়ে নিজস্ব সতর্কতা অ্যালার্ট-২ জারি করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক গতকাল শুক্রবার বিকেলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙরে থাকা জাহাজগুলোকে ইঞ্জিন চালু রাখতে বলা হয়েছে যাতে তাৎক্ষণিক নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারে। বন্দরের নিজস্ব জাহাজগুলোকে নিরাপদে থেকে ডাবল আপ মুরিং করতে বলা হয়েছে।
মিরসরাইয়ে প্রস্তুত ৮০টি সাইক্লোন সেন্টার

মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা প্রশাসন। উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও দুই পৌরসভা মেয়রকে নিয়ে সভা করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানির পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে বলে জানান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিজানুর রহমান।

কোস্টগার্ড মিরসরাই স্টেশনের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার জহিরুল ইসলাম জানান, মিরসরাইয়ের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে সাবধান করতে মাইকিং করা হচ্ছে। তাদের নিরাপদে থাকতে অনুরোধ করা হচ্ছে। উপকূলে ঝুঁকির মধ্যে থাকা বাসিন্দাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে। যদি ঘূর্ণিঝড় আমাদের এলাকায় আঘাত হানে তাহলে তাদের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনুরোধ করা হয়েছে।

উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে সেখানে পাহাড়ের ওপরে ও পাদদেশে যারা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে তাদের চিহ্নিত করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। সেই লক্ষ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিকটবর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখা সরাসরি সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত না হানলেও এর প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে উপকূলবাসী। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা সঙ্কটের কারণে ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলের অধিকাংশ বেড়িবাঁধ বর্তমানে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তাই সামান্য জলোচ্ছ্বাস বা নদ-নদীর জোয়ারের প্রভাবে এসব জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙে লোনাপানি ঢোকে লোকালয়ে। ফলে স্থানীয়দের আশঙ্কা ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভাঙতে পারে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, আবহাওয়া অধিদফতরের যে পূর্বাভাস তাতে সাতক্ষীরার উপকূলে ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাত হানার সম্ভাবনা কম। এরপরও এই মৌসুমে মে-জুন মাসে আমরা উপকূলবর্তী জেলা হিসাবে এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় একটা প্রস্তুতি সব সময় নিয়েই রাখি।

ঝালকাঠি প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখা শক্তি সঞ্চয় করে এখন অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হওয়ায় সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। সাগরে মাছ শিকার করা জেলেরা ট্রলার ও নৌকা নিয়ে উপকূলের নিরাপদ স্থানগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে বলে কাঁঠালিয়ায় মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতি জানিয়েছে।

ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম জানিয়েছেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- দুর্যোগপূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ের প্রস্তুতি। জেলায় ৩৬৫ টন খাদ্যশস্য মজুদ রাখা হয়েছে। দুর্যোগ পরবর্তী জরুরি ত্রাণ বাবদ ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এক হাজার বান্ডিল ঢেউটিন ও ৩ হাজার ৭০০ কম্বল ও ১০০০ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার মজুদ রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলায় ঝালকাঠি মোট ৬১টি সাইক্লোন শেল্টার ও ৩৬৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।

মংলা (বাগেরহাট) সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে মংলাসহ সব নদী উপকূলীয় এলাকায় সর্বসাধারণকে সতর্ক করতে সচেতনতামূলক মাইকিং করছে কোস্টগার্ড।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/747522