১২ মে ২০২৩, শুক্রবার, ১২:০৪

লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় গ্রামের জনজীবন

বহু স্থানে দিনে ১০-১৩ বার বিদ্যুৎ থাকছে না

কক্সবাজারের পেকুয়ার সাতটি ইউনিয়নে পাঁচটি বিতরণ লাইনের মাধ্যমে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। এতদিন গড়ে দিনে ২০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেলেও এখন চিত্র ভিন্ন। বুধবার দুপুর ১২টা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় উপজেলার ‘টৈটং ও রাজাখালী (আংশিক)’ লাইনের গ্রাহকরা বিদ্যুৎ পেয়েছেন মাত্র ৮ ঘণ্টা। ১৩ বার লোডশেডিং, এর মধ্যে বুধবার দুপুর ১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টানা সাড়ে চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। উপজেলায় অন্যান্য লাইনের গ্রাহকরাও দিনে গড়ে ৯ থেকে ১১ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

পেকুয়ার মতো দেশের বহু স্থানে এখন কমবেশি একই চিত্র। লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় এখন গ্রাহকরা। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক কার্যক্রম। চলমান এসএসসি পরীক্ষার্থী ছাড়াও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা চরম বিপাকে পড়েছেন। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, জাতীয় গ্রিড থেকে তারা দৈনিক চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎও পাচ্ছে না। সঙ্গে সংস্কার কাজের জন্য বিদ্যুৎ বিভ্রাট দীর্ঘ হচ্ছে।

পেকুয়ার উজানটিয়া, মগনামা ও রাজাখালী ইউনিয়নের কিছু অংশ নিয়ে পল্লী বিদ্যুতের একটি লাইন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই লাইনে বুধবার দুপুর ১২টা থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১১ বার লোডশেডিং হয়েছে। এর মধ্যে বুধবার দুপুর ২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ আড়াই ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। একই সময়ে শিলখালী-বারবাকিয়া লাইনে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করে ১০ বার এবং বুধবার রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত টানা দুই ঘণ্টা লোডশেডিং ছিল।

সিরাদিয়া-মইয়াদিয়া-নন্দীরপাড়া লাইনে সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টাসহ লোডশেডিং হয় ৯ বার। উপজেলার ‘ভিআইপি’ লাইনখ্যাত সদর ইউনিয়নের গ্রাহকরা নিয়মিত ২০ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ পেয়ে এলেও, গত ২৪ ঘণ্টায় পেয়েছেন মাত্র ৯ ঘণ্টা। বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করেছে ১০ বার। গতকাল সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। সবচেয়ে নাজুক টৈটং ও রাজাখালী আংশিক লাইনে। লোডশেডিং হয়েছে ১৩ বার এবং বুধবার টানা সাড়ে চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। বৈদ্যুতিক খুঁটি সংস্কারের কারণে এমনটি হয়েছে বলে দাবি করেন পেকুয়া জোনাল অফিসের জুনিয়র সহকারী প্রকৌশলী রকিব উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘লাইনে একটি খুঁটির বিচ্ছিন্ন তার সংস্কারে চার ঘণ্টার বেশি লাগে। এ সময় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখা হয়। সঙ্গে চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ কম পাওয়ায় তিনটি লাইন সচল রাখতে হচ্ছে।’

উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের বাসিন্দা আবু তালেব জানান, তীব্র গরমের সঙ্গে বিদ্যুতের ‘কানামাছি খেলায়’ তাঁরা অতিষ্ঠ। পেকুয়ার একটি ক্লিনিকের পরিচালক কামরান জাদিদ মুকুট বলেন, ‘বুধবার হাসপাতালে সব মিলে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেয়েছি। কিছুক্ষণ পরপর জেনারেটর চালু করতে হয়েছে।’

কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পেকুয়া জোনাল অফিসের এজিএম দীপন চৌধুরী বলেন, ‘উপজেলায় ৪১ হাজার গ্রাহকের দিনে ১৩-১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এখন জাতীয় গ্রিড থেকে বরাদ্দ দিচ্ছে ৪-৫ মেগাওয়াট। তাপদাহ কমে গেলে পরিস্থিতি সহনীয় হবে।’

খুলনার কয়রার সর্বত্র গরমের সঙ্গে তীব্র লোডশেডিংয়ে জনজীবন দুর্বিষহ। উপজেলা সদরের অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও গ্রামের চিত্র ভয়াবহ। সেখানে একবার বিদ্যুৎ গেলে কখন আসবে, তার খবর থাকছে না। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বুধবার দুপুর ১২টা থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত কয়রার কালনা গ্রামে লোডশেডিং হয় সাতবার। বুধবার সকাল ১১টায় গিয়ে বিদ্যুৎ আসে দুপুর দেড়টায়। আবার সাড়ে ৩টায় গিয়ে আসে বিকেল ৫টায়। এর পর সন্ধ্যা ৭টায় গিয়ে রাত সাড়ে ৮টা, রাত পৌনে ১১টায় গিয়ে আসে রাত ১টায়। এক ঘণ্টা থেকে আবারও চলে যায়, আসে রাত সাড়ে ৩টায়। বৃহস্পতিবার ভোর ৬টার দিকে আবারও চলে যায়, আসে সাড়ে ৮টায়। এর পর বেলা ১১টায় গিয়ে আসে দুপুর ১টায়। এ হিসাবে গত ২৪ ঘণ্টায় গ্রামটিতে প্রায় ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। অন্যান্য গ্রামে খবর নিয়ে দেখা গেছে, দিন-রাত মিলে ৭-৮ বার লোডশেডিং হয়েছে। উপজেলার মহেশ্বরীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত কয়েকটি গ্রামে দিনে কিছুটা সময় থাকলেও রাত কাটাতে হচ্ছে বিদ্যুৎবিহীন। গ্রাহকদের অভিযোগ, বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন ইচ্ছা করে রাতে বিদ্যুৎ দিচ্ছেন না। তবে কয়রা জোনাল অফিসের কর্মকর্তাদের দাবি, যেসব এলাকায় কলকারখানা ও সেচ কাজ কম, সেখানে লোডশেডিং রেখে অন্য স্থানে কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

কয়রার ঘুগরাকাটি বাজারের বেকারি কারখানার মালিক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এক সপ্তাহ লোডশেডিং যে হারে হচ্ছে, কারখানা টিকিয়ে রাখতি পারব কিনা বুঝতিছি নে। বাধ্য হয়ে কর্মচারীদের ছুটি দিতি হয়েছে।’ বাজারের ৪টি বিস্কুট কারখানা, ৩টি অটো রাইসমিল, ৬টি করাতকল বিদ্যুতের অচলাবস্থায় এক সপ্তাহ ধরে বেশিরভাগ সময় কাজ বন্ধ রয়েছে। দক্ষিণ বেদকাশি গ্রামের ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘যখন কারেন্ট দরকার, তখনই থাকে না। ছাওয়াল-মেয়েগের পড়াশুনাও লাঠে উঠেছে।’

খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কয়রা জোনাল অফিসের ডিজিএম কায়সার রেজা বলেন, ‘উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১০ মেগাওয়াট হলেও পাচ্ছি অর্ধেক। যে কারণে দিন-রাতে প্রতিবার দেড় ঘণ্টা করে ছয়বার লোডশেডিং হচ্ছে।’

শতভাগ বিদ্যুতায়িত উপজেলা গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরেও এখন মিলছে না নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। শহরের মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও গ্রামে ৬-৮ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বলছে, চাহিদার তুলনায় এখানে ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম দেওয়া হচ্ছে। উপজেলার ধাপেরহাট ইউনিয়নের তীলকপাড়া গ্রামের কৃষক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘রাতে একবার বিদ্যুৎ গেলে এক ঘণ্টাতেও দেখা মেলে না। প্রতিরাতে ৩-৪ বার বিদ্যুৎ যায়।’

বুধবার দুপুর ১২টা থেকে গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত সাদুল্যাপুর শহরের ফিডারে বিদ্যুৎ গেছে ৫ বার। বুধবার সন্ধ্যা ৭টা ১৪ মিনিটে গেলেও বিদ্যুৎ আসে ৭ মিনিট পরই। রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে গিয়ে আসে ৪০ মিনিট পর। বৃহস্পতিবার ভোর সোয়া ৪টায় বিদ্যুৎ চলে যায়। আসে প্রায় এক ঘণ্টা পর। সকাল সাড়ে ১০টায় এবং বেলা সোয়া ১১টায় দু’দফায় গিয়ে বিদ্যুৎ আসে প্রায় আধা ঘণ্টা পর।

সাদুল্যাপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডিজিএম মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘উপজেলায় গ্রাহক ৮৪ হাজার ৫৪০ জন। গরমের সময় পিক আওয়ারে গড়ে ১৫ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও মিলছে ১০ মেগাওয়াট। এর পরও এখানে লোডশেডিং সহনীয় রয়েছে।’

পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং রেখে, এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গ্রাহকরা। ইন্দুরকানী গ্রামের মঞ্জু আকতার ও শাহনা বেগম বলেন, ‘রাতে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। শিশু ও বয়স্করা গরমে সীমাহীন কষ্ট করছে।’
ইন্দুরকানী পল্লী বিদ্যুতের শাখা ইনচার্জ ইসলাম আহম্মেদ বলেন, ‘২৪ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পাচ্ছি ৮ মেগাওয়াট। বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।’

https://samakal.com/bangladesh/article/2305172113