১২ মে ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৫৪

ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে

বাজেটের আকার বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে দেশী বিদেশী ঋণ

প্রতি বছরই বাজেটের আকার বাড়ছে। আর সেই সাথে বাড়ছে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে দেশীয় ও বিদেশী ঋণ। আর এ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বাজেটের বড় একটি অংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। এ জন্য বাজেটে প্রতি বছরই সুদ পরিশোদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের সুদের জন্য যেখানে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৮০ হাজার কোটি টাকা, আগামী অর্থবছরের জন্য এ বরাদ্দ বেড়ে হচ্ছে এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ানো হচ্ছে। সেই সাথে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তা আদায় হয় না। বাধ্য হয়েই দেশী-বিদেশী উৎস থেকে বাড়তি ঋণ নিতে হয়। বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। প্রতি বছরই ঋণের সুদ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার দায় বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রার ঋণের সুদ নির্ধারণ হয় লন্ডন ইন্টার ব্যাংক রেটকে (লাইবর) ভিত্তি ধরে। লাইবর রেটের সাথে বাড়তি শূন্য ৫ থেকে ১ শতাংশ সুদ ধার্য হয়। আর বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের সুদ নির্ধারণ হয় লাইবর রেটের সাথে সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাবের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসহ অন্যান্য দেশের ব্যয় বেড়ে গেছে। বিশেষ করে জ্বালানি খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তাদের অভ্যন্তরীণ সুদহার বেড়ে গেছে। আর এ কারণে লাইবর রেট অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে।

পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২০ সালের গড় লাইবর রেট ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ, সেখানে গত বছর তা বেড়ে হয়েছিল ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এক বছর পর গতকাল তা এক বছর মেয়াদি ঋণের লাইবর সুদহার বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। লাইবর রেট বেড়ে যাওয়ায় বিদেশী ঋণের সামগ্রিক সুদহার বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যেখানে বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল যেখানে ১৭ হাজার কোটি টাকা, আগামী অর্থবছরে তা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

এ দিকে বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আরো একটি কারণ হলো ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান অর্থাৎ টাকার মান অবমূল্যায়িত হওয়া। এক বছরে আগেও যেখানে প্রতি ডলারের জন্য ব্যয় করতে হতো ৮৬ টাকা, এখন তা বেড়ে ১১০ টাকা থেকে ১১২ টাকা উঠে গেছে। বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয় ডলারে। আগে যেখাতে প্রতি ডলার ৮৬ টাকায় কিনে পরিশোধ করতে হতো, এখন এর জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে ১১০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডলারের জন্য বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে প্রায় ২৪ টাকা। এভাবেই বিদেশী ঋণের সামগ্রিক সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

এ দিকে বিদেশী ঋণের পাশাপাশি স্থানীয় ঋণের সুদও পরিশোধে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বিদেশী ঋণের পাশাপাশি স্থানীয় উৎস থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আর প্রতি সাপ্তাহে ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ ঋণ নেয়া হবে তার আগামী কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়। ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ তুলে দেয়ার দায়িত্ব থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের। ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট থাকে তখন ঋণের সুদহার বেড়ে যায়। আবার টাকার সরবরাহ বেশি থাকলে ঋণের সুদহারও কমে যায়। চলতি বছরে ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ও ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি, আমানতের সুদহার তুলনামূলক কম হওয়ায় ব্যাংকে কাক্সিক্ষত হারে আমানত সংগ্রহ হচ্ছে না। এ জন্য অনেক ব্যাংক কলমানি মার্কেটসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে। এমনি পরিস্থিতিতে চলতি বছরে ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধের ব্যয়। অপর দিকে বাজেটের আকার বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ঘাটতি ব্যয় মেটাতেও অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সবমিলে ঋণ ও সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যেখানে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৬৩ হাজার কোটি টাকা, আগামী অর্থবছরের জন্য তা বাড়িয়ে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সবমিলে চলতি অর্থবছরের ঋণ ও সুদ পরিশোধে যেখানে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা, আগামী অর্থবছরের জন্য তা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এক লাখ দুই হাজার কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। সুদ পরিশোধ বাড়ছে প্রায় ২৭ শতাংশ। ঋণ ও সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় উন্নয়ন খাতে তেমন বরাদ্দ বড়ানো যাচ্ছে না।

জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রায় সাত লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেয়া হচ্ছে। যা চলতি অর্থবছরের জন্য ছিল ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এনবিআর, এনবিআরবহির্ভূত এবং করবহির্ভূত রাজস্ব থেকে মোট পাঁচ লাখ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের জন্য ছিল চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/747257