১১ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১১:২৮

অবসরপ্রাপ্তদের ভারে ন্যুব্জ স্বাস্থ্য বিভাগ

অবসরপ্রাপ্তদের দিয়ে চলছে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ। এই অবসরপ্রাপ্তদের শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে এ বিভাগের কার্যক্রম
চালানো হচ্ছে। এ নিয়োগ পেয়ে অনেকে গত ৮ থেকে ৯ বছর ধরে ইচ্ছামতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। স্বাস্থ্য বিভাগে এখন অবসরপ্রাপ্তদের ন্যুব্জ অবস্থা বিরাজ করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুরু করে একাধিক চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক তদবিরের মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। বছরের পর বছর এমন কর্মকা- যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এতে হতাশা কাজ করছে মিড লেভেলের কর্মরত চিকিৎসকদের মধ্যে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সেক্টরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কেন? প্রশ্ন চিকিৎসকদের মাঝে। পিআরএল থেকে এসে পুনরায় বিভাগীয় প্রধানের চেয়ারও দখল করতে চায়। তা সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, অধিদপ্তর ও হাসপাতালের পদগুলোয় দায়িত্ব পালনের মতো একাধিক যোগ্য ব্যক্তি থাকলেও এবং সবকিছু জেনেও নীতিনির্ধারকরা রহস্যজনক কারণে চুপ থাকছেন।

এতে করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে যোগ্য ব্যক্তিরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, প্রায় সময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হচ্ছে। অধিদপ্তর থেকে শুরু করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ বিভিন হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে নিয়োগ দেয়া হয় অবসরপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞদের।

দেশের জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, চুক্তিভিত্তিক কেন নিয়োগ দিতে হবে। উচিত না। সিস্টেমের মধ্যেই তো নিয়োগ দেয়া সম্ভব। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরুদ্ধে সব সময় মিড লেভেলে বিরোধিতা করা হয়। তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে তাদের প্রমোশন আটকিয়ে যায়। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধান আছে। আবার দপ্তরগুলোতে যোগ্য ব্যক্তিও আছে। শীর্ষপদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে অগ্রাধিকার প্রাপ্তদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। এর প্রভাব দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডেও পড়তে পারে। এতে পদসোপান ধারাও ব্যাহত হয়। যোগ্যরা নিচ থেকে উপরে উঠতে না পারলে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ২০২০ সালের নভেম্বরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিয়োগ পান। ২০২০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর তার পিআরএল শুরু হওয়ার কথা। মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগের আগে তার চাকরির বয়স ছিল এক মাসের মতো। তাকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের শেষ কার্যদিবস ছিল গত বছরের ২৯শে ডিসেম্বর। পদটি ৩০শে ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত শূন্য ছিল।

১০ই জানুয়ারি ডা. আবুল বাসারকে আবারো দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিতে মহাপরিচালক পদে বসানো হয়। ডা. খুরশীদ আলমের আগের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের পিআরএল শুরুর তারিখ ছিল ২০১৯ সালের ১৪ই এপ্রিল। তিনিও দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। তবে করোনাভাইরাসকালে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগে তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে বাধ্য হন। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তিনি নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন দুদকে। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মহাপরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মাদ নূরুল হকও। ২০১৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তার চাকরির বয়স শেষ হয়। এর দেড় মাস আগেই তিনি এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। এক বছর পার হওয়ার পর তাকে আরেকবার নিয়োগ দেয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদের বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হয় ২০১৪ সালের ১০ই জানুয়ারি। পরদিন থেকে তার ‘পোস্ট রিটায়ারমেন্ট লিভ’ (পিআরএল) বা অবসরোত্তর ছুটি শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক পরিচালক পদে নিয়োগ পান। এরপর দুই ও তিন বছর করে বাড়িয়ে একই চেয়ারে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। ৯ বছর ধরে তিনি চুক্তিভিত্তিক পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।

সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ তিনি সেই পদও দখল করে রাখেন। ফলে মন্ত্রণালয় চাইলেও ওই পদে অন্য কাউকে পদোন্নতি দিতে পারে না। যেমন অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদের কারণে নিউরো মেডিসিন অধ্যাপক পদে এক দশক ধরে কাউকে পদোন্নতি দেয়া যাচ্ছে না। অথচ বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রতিবছর নিউরো সার্জারি ও নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি হচ্ছে।

সূত্র জানায়, আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফার বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হয় ২০১৭ সালের ২৯শে এপ্রিল। এর পরদিন থেকে তার পিআরএল শুরু হওয়ার কথা। মেয়াদ শেষ হলেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে তিনি ছয় বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ আসনে বসে আছেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মকসুদুল হকের ২০২০ সালের ২৪শে জানুয়ারি পিআরএল শুরু হওয়ার কথা। সাড়ে তিন বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। এ ছাড়া জাতীয় অর্থোপেডিকস ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গণি মোল্লা দুই বছর করে পর পর দুইবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে পাঁচ বছর শেষ করেছেন। এখনো তিনি ওই পদে বহাল। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালামের পিআরএল শুরু হওয়ার কথা ২০১৮ সালের ২রা এপ্রিল থেকে। একই পদে তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার অবসরে গেছেন এক মাসের উপরে। কিন্তু সরকারি অর্ডার ছাড়াই তিনি এখনো চেয়ারে বসে আছেন। বিভাগটিতে বর্তমানে বিভাগীয় প্রধান পদটি ফাঁকা। যথানিয়মে তিনি চলে গেলে সেই পদে ডা. শফিকুল ইসলাম বিভাগীয় প্রধান হবেন বলে বিভাগীয় সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা. শফিকুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন।

যোগ্যপ্রার্থী থাকা সত্ত্বেও বহু বছর ধরে হাসপাতালটির রক্ত বিভাগে বিভাগীয় প্রধানের পদ দখল করে বসে আছেন অধ্যাপক এমএ খান। হাসপাতালটির নবজাতক বিভাগও চলছে একইভাবে। এতে হতাশ নিচের উত্তরসূরিরা। এর ফলে মিড লেভেলে চিকিৎসকরা হতাশ হয়ে চাকরি ছেড়ে বেসরকারি হাসপাতালের দিকে যাওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এতে সরকারি হাসপাতালে সাধারণ গরিব রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। উপকৃত হবেন বেসরকারি হাসপাতালে আগত ধনীরা।

গত ৩ বছর আগে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. বিল্লাল আলম চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে এসে বিভাগীয় প্রধানের চেয়ার জোর করে দখলের চেষ্টা করে। পরে তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. টিটু মিয়া তা ঠেকিয়ে দেন। তখন যথানিয়মে যিনি বিভাগীয় প্রধান হওয়ার কথা তিনিই প্রধান হন। তিনি হলেন- অধ্যাপক ডা. হাফিজ সরদার। বিষয়টি নিয়ে নিচের লেভেলে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার কারণে যোগ্য লোক তৈরিতে বাধা দেয়। মিড লেভেলে সহযোগী অধ্যাপক এবং সহকারী অধ্যাপক যারা আছেন তারা যদি সময়মতো পদোন্নতি না পান এবং পদ যদি ব্লক হয়ে থাকে তাহলে তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করবে। তারা করপোরেশন হাসপাতালে চলে যাবে। এতে ভবিষ্যতে বড় প্রভাব পড়বে সরকারি স্বাস্থ্য সেবায়।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আজিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে তার মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলে ফোনটি ব্যস্ত আছে বলে টোনে উল্লেখ করা হয়। ক্ষুদে বার্তা দিলেও সাড়া মিলেনি।

https://mzamin.com/news.php?news=54880