১০ মে ২০২৩, বুধবার, ৫:৪২

কি কাজে আসছে পিএইচডি গবেষণা?

একটা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে পিএইচডি গবেষণা অবদান রাখে। উন্নত অনেক দেশেই পিএইচডি গবেষণা প্রতিবেদন গ্রহণ করা হয় সরকারিভাবে। তা থেকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মোটা দাগে এটা একটা প্রতীকী অর্থেই যেন ব্যবহার হয়ে আসছে। পিএইচডি স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ একাডেমিক ডিগ্রি। শিক্ষক, গবেষক ও স্কলারদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই ডিগ্রি অর্জনের জন্য বেশ কয়েকটি ধাপ পেরুতে হয় শিক্ষার্থীদের। এরমধ্যে অন্যতম গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ও বহিঃপরীক্ষক নিয়োগ, এলিজেবিলিটি টেস্ট, কোর্স ওয়ার্ক, একাডেমিক সেমিনার। আন্তর্জাতিক মানের লেখনীর পরই অর্জন করা সম্ভব হয় এই ডিগ্রি। উচ্চতর পর্যায়ে কষ্টসাধ্য এই ধাপগুলো উত্তরণের জন্য করতে হয় কঠোর পরিশ্রম।

কিন্তু অধিকাংশ সময়ে উল্টো চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের রেওয়াজ অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডক্টরেট ডিগ্রি খুবই প্রয়োজন। এরমাধ্যমে মেলে পদোন্নতি। এমপিওভুক্ত কলেজের শিক্ষকদের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনে মেলে ইনক্রিমেন্ট। আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নিয়ম অনুযায়ী সহযোগী অধ্যাপকের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি বাধ্যতামূলক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি পদোন্নতির পূর্বশর্ত। পিএইচডি ডিগ্রিধারী কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলে তিনি ৩টি অগ্রিম বেতন বৃদ্ধির সুবিধা পান। আবার ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করায় অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও এদিকে ঝুঁকছেন।

তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের এসব সুবিধা মেলার কারণেই নানা ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন তারা। ফলে নামকাওয়াস্তে প্রতিবেদন দিয়েই সেরে ফেলছেন তাদের পিএইচডি। আর পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে দুর্নীতির খবর নতুন কিছু নয়। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জালিয়াতি করে ডিগ্রি অর্জনের তথ্যও আসে সময়ে সময়ে। এমন ঘটনায় শাস্তির মুখেও পড়েছেন কেউ কেউ।

বাংলাদেশে ভুয়া পিএইচডির ঘটনা আমেরিকা ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ইউএসএ (বাংলাদেশ স্টাডি সেন্টার) থেকে অসংখ্য ভুয়া (প্রায় পাঁচ হাজার) পিএইচডি ডিগ্রিধারী বের হয়েছে। যদিও বর্তমানে দেশে এই স্টাডি সেন্টারের কার্যক্রম নেই। এই স্টাডি সেন্টারের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশনও।

বাংলাদেশে পিএইচডি ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বাড়ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে করানো হয় পিএইচডি। এ ছাড়াও চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ভর্তি করানো হয়েছে শিক্ষার্থী। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করানোর জন্য অনুমোদন চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিভিন্ন সময়ের কথাবার্তায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে ইতিবাচক কথাই বলা হয়েছে। তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, যত্রতত্র মান নিশ্চিত না করে পিএইচডির সুবিধা না দেয়াই ভালো। এতে গবেষকদের মান আরও খারাপ পর্যায়ে চলে যাবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছেন হৃদয় রায়হান। তিনি বলেন, আমার গবেষণার বিষয় উচ্চতর সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে। এই বিষয়ে বাংলাদেশে উচ্চতর গবেষণা একেবারেই হয়নি বললেই চলে। গবেষণা যেগুলো হয়েছে বিভিন্নভাবে প্রাথমিক বিষয়ে। আমাদের এনথ্রোপলজি বিভাগে এই বিষয়ে একটা বই পড়ানো হয়। কিন্তু এটা খুবই কমন বিষয়। কিন্তু আমার গবেষণার বিষয়ে আমি সার্ফেস থেকে তথ্য সংগ্রহের পর একটা ডাটা ক্যালকুলেশনেও গিয়েছি। কিন্তু আমার যখন উচ্চতর রেফারেন্স প্রয়োজন হয় তখন আর কোনো বই বা লেখা পাই না। এজন্য ইন্টারনেটে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন আছে কিন্তু এগুলো অ্যাকাউন্ট ছাড়া পুরোটা সংগ্রহ করা যায় না। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাডে ই-মেইল এড্রেস ও যাবতীয় তথ্য দিয়ে আবেদন করতে হয়। কিন্তু এটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। একটা গবেষণার জন্য এসব কাজে একাধিক রেফারেন্স প্রয়োজন হয় কিন্তু এই তথ্য সংগ্রহ করা একটা দুরূহ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছেন এমন একজন বলেন, জার্নালের জন্য নিজে থেকেই ব্যবস্থা করতে হয়। আমি জার্নালের জন্য আমার বিদেশে থাকা পরিচিতদের সহযোগিতা নেই। আমার যে জার্নাল প্রয়োজন সেটির লিংক দিয়ে অনুরোধ করি সংগ্রহের জন্য। তারা খুব সহজেই এই ই-মেইল আইডি পাচ্ছে কিন্তু আমরা পাচ্ছি না।

একই সময়ে দেশের বাইরে থাকা পিএইচডি গবেষকরা কীভাবে কাজ করছেন? অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী শিক্ষার্থী রাফা বিনতে হাসান বলেন, আমার গবেষণার বিষয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আমি এখানে প্রতিটি বিষয়ে রেফারেন্স বই লাইব্রেরিতেই পাই। আর কোনো জার্নালের প্রয়োজন হলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্ট এক্সেস আছে যা দিয়ে আমি সহজেই পেয়ে যাই। তিনি প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখানে সাধারণত দুই বছর সময়ের মধ্যেই পিএইচডি সম্পন্ন করা সম্ভব। বাংলাদেশে তথ্য ও জার্নাল সংগ্রহ করাটাই প্রধান প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু এখানে তথ্যের প্রবাহ খুবই সহজলভ্য। আমরা মূলত আমাদের গবেষণা নিয়েই ভাবতে পারি। সেইসঙ্গে একটা অর্থনৈতিক সাপোর্টও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশে পিএইচডি করতে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তথ্য সংগ্রহ।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমি অস্ট্রেলিয়া ও এর আশপাশে ঘটে যাওয়া গত ১২ বছরের প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটা ডাটা চেয়ে আবেদন করেছিলাম। তারা আমাকে রিপ্লেতে জানায়, ৩ কর্মদিবসের মধ্যে সরবরাহ করবে। এই তথ্য আমি ২ কর্মদিবসের মধ্যেই পেয়ে যাই।

একই কথা বলেন, ইংল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পারভেজ হাসান। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশে পিএইচডি শুরু করেছিলাম। এরপর এখানে সুযোগ মেলার পর চলে আসি। আমি ২০২২ সালের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি। এরপর প্রথমেই তারা আমাদের গবেষণা সংশ্লিষ্ট একাধিক রেফারেন্স জার্নাল, পূর্বের শিক্ষার্থীদের এই বিষয়ে প্রাপ্ত ফল, ই-লাইব্রেরি এক্সেস দিয়ে দেয়। যেটা কিনা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সংগ্রহ করতে হয়। মিললেও সময়সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে মালয়েশিয়ার ইউনির্ভাসিটি অব সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আফতাব আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা খুব একটা হয় না। দেশের বাইরে গবেষণা প্রতিবেদনের যে জার্নাল প্রকাশিত হয় তা আন্তর্জাতিক মানদ-ের আওতাধীন করা হয়। এগুলো জার্নাল যদি ইনডেক্সে থাকে তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়েও ভালো হয়।

তিনি বলেন, বিশ্বে আর জার্নালিজমের বেসিক নিয়ে আর গবেষণা হচ্ছে না। এখন উচ্চতর সাংবাদিকতা নিয়ে রিসার্চ হচ্ছে। দেশের বাইরে যদি পিএইচডি করতে যান তবে জানা যাবে এই ক্ষেত্রটা কতো বড়।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. শেখ শফিউল ইসলাম বলেন, যারা বাংলাদেশে পিএইচডি করছেন দুঃখজনক হলেও সত্য যে প্রোগ্রামে এনরোল করেও খুব সামান্য একটা অংশ এটা সম্পন্ন করতে পারেন। অনেক সময় ১০ শতাংশ বা তারও কম সময়মতো শেষ করতে পারেন। এর প্রধান কারণ, তথ্যের ঘাটতি।

আমাদের দেশে এখনো তথ্য দেবার ক্ষেত্রে উদারতার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। সরকারি, বেসরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত কোনো প্রতিষ্ঠানেরই তৈরি হয়নি। যখন কোনো তথ্যের প্রয়োজন হয়, তথ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ করা হয় না। সরবরাহ করা হলেও দীর্ঘসূত্রিতা করা হয়। অনেক সময় তথ্য পাওয়াই যায় না। দ্বিতীয়ত, যদিও বলা হচ্ছে আমরা তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর। কিন্তু তারপরও আমরা অনেক তথ্য গুছিয়ে রাখতে পারি নাই। তথ্যের স্টোর হাউস আমাদের দেশে এখনো আধুনিকভাবে সক্ষম হয়নি।

তিনি আরও বলেন, গবেষণার জন্য ফান্ডিংয়ের একটা বড় সমস্যা রয়েছে। সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দিক থেকে এই অর্থ দেয়া হয় না। সরকারিভাবে অনেককে খুব সামান্য একটা তহবিল সুবিধা দেয়। কিন্তু উন্নত দেশে করপোরেট প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করে। এই গবেষণা দিয়ে তাদের প্রয়োজনগুলো মেটানো হয়। এর মধ্যমে মানুষের চাহিদা ও সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। আমাদের দেশ মূলত গবেষকের আগ্রহেই এটা হয়ে থাকে। যারা গবেষণা করেন তারাও নানা সমস্যায় পড়েন। পরিবার, চাকরি সামলিয়ে গবেষণা করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেও সহযোগিতা মেলে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা জটিলতা তৈরি করে থাকে। তবে ইদানিং পরিবর্তন হচ্ছে। তবে এটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যত্রতত্র পিএইচডি ডিগ্রি মেলায় এখন এসব ব্যক্তিদের আগের মতো সম্মান নেই। শুধু তাই নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মুনাফার উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছেন। পরবর্তীতে তারা এদের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। আমরা চাই, তদারকি করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ভুয়া পিএইচডি বা জালিয়াতির ব্যাপারে আরও সচেতন হবে। সেসঙ্গে গুণগত গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=54721