৯ মে ২০২৩, মঙ্গলবার, ৬:২৫

লোডশেডিংয়ে হাঁসফাঁস

বইছে তাপপ্রবাহ। তার উপর লোডশেডিং। চট্টগ্রামে বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ মিলছে না। বিদ্যুতের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো তীব্র হয়েছে সুপেয় পানির সঙ্কট। তাতে জনজীবনে হাঁসফাঁস অবস্থা। গ্যাস ও পানির অভাবে বন্ধ পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের আটটি ইউনিট। তাতে উৎপাদনে ধস নেমেছে। চাহিদার এক তৃতীয়াংশও সরবরাহ মিলছে না। রাতে দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। দীর্ঘ প্রায় তিন মাস থেকে নগরীতে চলছে সুপেয় পানির সঙ্কট। কাপ্তাই হ্রদে পানি কমে যাওয়ায় জোয়ারের সময় চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির উৎস কর্ণফুলী এবং হালদা নদীতে লোনা পানি ঢুকে পড়ছে। তাতে ওয়াসার পানি পরিশোধন ও সরবরাহ ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। তার উপর টানা লোডশেডিং পানি সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। পানি বিদ্যুতের অভাবে সর্বত্রই চলছে হাহাকার। জনমনে ক্ষোভ, অসন্তোষ বিরাজ করছে।

ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার পর বিদ্যুতের চাহিদা এবং সেইসাথে সঙ্কট বাড়তে থাকে। তীব্র তাপ প্রবাহের মধ্যে বিদ্যুতের সঙ্কট জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, পানির অভাবে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ মহাপ্রকল্পের পাঁচটি ইউনিটের চারটি বন্ধ। একটি সন্ধ্যায় পিকআওয়ারে কিছু সময়ের জন্য চালু রাখা হচ্ছে। ২১০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার রাউজান তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ। বন্ধ রয়েছে শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট আরও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার ৪২০ মেগাওয়াট। একযোগে সব কেন্দ্র চালু থাকলে দুই হাজার ৩৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যায়। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটি, পানি ও গ্যাস সঙ্কটে বন্ধ বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। আবার জ্বালানি সাশ্রয় করতে গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল চালিত কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দিনের বেলা বন্ধ রেখে সন্ধ্যায় কিছু সময়ের জন্য চালু রাখা হচ্ছে। এর ফলে সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে রীতিমত ধস নেমেছে।

পিডিবির রেকর্ড বলছে, দুই হাজার ৩৮২ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে রোববার দিনের বেলায় ৭৬৯ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় পিকআওয়ারে ১২’শ ৪৭ মেগাওয়াট সরবরাহ মিলেছে। চট্টগ্রামে বিদ্যুতের মোট চাহিদা পিকআওয়ারে ১৪’শ ৫০ থেকে ১৫’শ মেগাওয়াট। চাহিদা এবং সরবরাহে বিশাল ব্যবধানের কারণে সঙ্কট তীব্র রূপ নিয়েছে। গতকাল দিনের বেলা নগরীর বেশিরভাগ এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করা হয়। আগ্রাবাদ, হালিশহর, পতেঙ্গা, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, বায়েজিদ, অক্সিজেন, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, মাদারবাড়ি, আন্দরকিল্লা, কাজির দেউড়ি, এনায়েত বাজার, চকবাজার, খুলশী, পাহাড়তলী, ফিরোজশাহ, শেরশাহসহ মহানগরীর বেশিরভাগ এলাকায় দিনভর মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া গেছে। কোন কোন এলাকায় টানা দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের পর আধা ঘণ্টাও বিদ্যুৎ সরবরাহ মিলেনি। রাতে-দিনে ২৪ ঘণ্টায় মাত্র কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছেন গ্রাহকেরা। গভীর রাতেও লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে।

শহরতলি এবং গ্রামের অবস্থা আরও নাজুক। সেখানকার গ্রাহকেরা বলছেন, এখন আর বিদ্যুৎ যায় না- মাঝে মধ্যে আসে। বিদ্যুতের অভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র গরমে কাহিল অসুস্থ বয়স্ক এবং শিশুরা। শ্রমজীবী মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। চলছে এসএসসি পরীক্ষা। বিদ্যুতের অভাবে পড়ালেখায় বিঘœ ঘটছে পরীক্ষার্থীদের। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর ভিড়। সেখানেও লোডশেডিংয়ের থাবা। বিদ্যুতের অভাবে হাসপাতালে জরুরি অপারেশনসহ চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। ঈদের ছুটি শেষে পুরোদমে চালু হয়েছে কল-কারখানা। আর এ সময়ে বিদ্যুতের তীব্র সঙ্কটে উৎপাদনের চাকা থমকে গেছে। বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কল-কারখানার চাকা সচল রাখা যাচ্ছে না। তাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তৈরি পোশাকসহ রফতানিতে ভাটার টান চলছে। এ অবস্থায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন শিল্প মালিকেরা। সিমেন্ট, ইস্পাত, তৈরি পোশাকসহ কারখানা মালিকেরা বিদ্যুৎ সঙ্কটে চরম বিপাকে পড়েছেন। উৎপাদন থমকে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে আর্থিক সঙ্কট। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রামের সার্বিক আমদানি-রফতানি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে।

বিদ্যুৎ সঙ্কট বেড়েছে স্বীকার করে পিডিবি চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরবরাহ কমে গেছে। তাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। চট্টগ্রামের চাহিদা সাড়ে ১৪শ’ মেগাওয়াট। তবে এর বিপরীতে কখনো ৬০০, কখনো ৭০০ আবার কখনো কিছুটা বেশি সরবরাহ মিলছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় সঙ্কট বাড়ছে। কবে নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি হবে সে বিষয়েও স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেননি তিনি। এদিকে বিদ্যুতের সাথে পাল্লা দিয়ে পানি সঙ্কটও বেড়েই চলেছে। লোনা পানির আগ্রাসন এবং মাত্রাতিরিক্ত শ্যাওলার কারণে ওয়াসার পানি উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। নগরীতে পানির চাহিদা দিনে প্রায় ৬০ কোটি লিটার। বিপরীতে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ কোটি লিটার। লোনা পানির কারণে ১২ ঘণ্টা পানি পরিশোধন বন্ধ রাখা হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় বাকি ১২ ঘণ্টাও পানি পরিশোধন ও সরবরাহ নির্বিঘœ করা যাচ্ছে না। সুপেয় পানির সঙ্কট মেটাতে ওয়াসার ৯৫টি গভীর নলকূপের মধ্যে বেশিরভাগ চালু করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় গভীর নলকূপ থেকেও পর্যাপ্ত পানি মিলছে না।

বিগত এক দশকে বিদ্যুৎ এবং পানি সঙ্কট নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অথচ তার কোন সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। নগরীতে জরুরিভাবে সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে ক্যাব চট্টগ্রামের নেতারা। তারা বলেন, গরমে পানির চাহিদা যখন বেড়ে গেল তখন চট্টগ্রাম ওয়াসায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নগরীর প্রায় অর্ধেক এলাকায় চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণ পাওয়া যাচ্ছে। সুপেয় পানির জন্য মানুষকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বেসরকারি পানি উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে কিনে পান করতে হচ্ছে। দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজনীয় পানি না পাওয়ায় মানুষের ভোগান্তির মাত্রা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে।

শুরু থেকেই ওয়াসা লবণাক্ততার বিষয়টি গোপন করে এসেছে। শুষ্ক মৌসুমে ওয়াসার পানিতে লবণের বিষয়টি আরো দু-এক বছর আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। এরপরও ওয়াসা এ ব্যাপারে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। যার খেসারত এখন জনগণকে দিতে হচ্ছে। অনেক এলাকায় নালার দুর্গন্ধযুক্ত, ময়লা ও কালো পানি পাচ্ছেন নগরবাসী। ওয়াসার বেশিরভাগ সরবরাহ লাইন পুরোনো হওয়ায় লিকেজের কারণে পানির অপচয় এবং পানি দুষিত হয়ে পড়ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি ওয়াসা। অথচ তারা এখন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায় সারছে। তারা নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও পানির মূল্য বাড়াতে নতুন পরিকল্পনায় ব্যস্ত। ওয়াসার পরিচালনা পর্ষদ ও সরকারের পক্ষে তদারকি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও রহস্যজনক। সংকটে কারও তৎপরতা দৃশ্যমান না হওয়ায় হতাশাজনক।

ক্যাব নেতারা বলেন, এমন নাজুক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে নগরবাসী চরমভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। ওয়াসার পানি পান করে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। ক্যাব নেতা এসএম নাজের হোসাইন, কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, সাংবাদিক এম নাসিরুল হক, জেসমিন সুলতানা পারু, অজয় মিত্র শংকু বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন।

https://dailyinqilab.com/national/article/573155