৮ মে ২০২৩, সোমবার, ২:৫৬

ডলার সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে

দেশে দীর্ঘদিন থেকে শুরু হওয়া ডলার সংকট পুরোপুরি কাটেনি। এরই মাঝে আমদানি দায় ও এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বড় অঙ্কের ডলার ছাড় করা হচ্ছে। এদিকে রিজার্ভে ডলার বৃদ্ধির অন্যতম সূচক রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়ও কমেছে। সব মিলিয়ে ডলার সমস্যা থেকে মুক্তির আগেই উল্টো আরও সংকটে ঘনীভূত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

অর্থনীতিবিদরা জানান, এর আগে ডলার সংকট শুরু হলে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে বিলাসীপণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা হয়। যদিও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করতে বেশ হিমশিম খেতে হয় ব্যবসায়ীদের। ফলে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। যার রেশ এখনো চলমান। তবে সামনের দিনে ডলার সংকট আরও ঘনীভূত হলে দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়বে। পাশাপাশি চাপে পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি।

সূত্র জানায়, এক বছর আগে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৪০৬ কোটি ডলার।

এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০.৯৩ বিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার কোটি ডলারে। গত মার্চের শেষে রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১১৪ কোটি ডলার। গত এক মাসের হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ৮ কোটি ডলার। ধারণা করা হয়েছিল রোজা ও ঈদ উপলক্ষে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। এতে রিজার্ভও কিছুটা বাড়বে। কিন্তু এবার রোজা ও ঈদে রেমিট্যান্স প্রবাহ খুব বেশি বাড়েনি। একইসঙ্গে রপ্তানি আয়েও নেতিবাচক অবস্থা। এদিকে রোজা উপলক্ষে আমদানি বেড়েছে। সবমিলে রিজার্ভ কমেছে। এদিকে সদ্য বিদায়ী এপ্রিল মাসে ১৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার ডলার বা ১৮ হাজার ১৩ কোটি টাকার বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। আবার গত মার্চ মাসে এসেছিল ২০১ কোটি ৭৬ লাখ ডলার, সে হিসাবে মার্চের তুলনায় এপ্রিলেও প্রায় ৩৩ কোটি ডলার কম এসেছে।

জানা গেছে, আমদানি দায় পরিশোধ করতে ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করার জন্য ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে রেকর্ড ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। পাশাপাশি চলতি সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল সময়ের আমদানি বিল ১১২ কোটি ডলার পরিশোধ করার কথা রয়েছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বড় ধরনের পতন হতে যাচ্ছে। আকু বিল পরিশোধ করা হলে ৭ বছরের মধ্যে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়নের নিচে নেমে আসবে। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ছিল ৩০.৩৫ বিলিয়ন ডলার।

সূত্রমতে, আগামী নভেম্বরে মিলবে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ। এর আগে চলতি মাসের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তার অর্থ বাবদ ৫০ কোটি ডলার মিলতে পারে। তখন রিজার্ভ কিছুটা বাড়বে।

সূত্রমতে, আগে রিজার্ভ বাড়তো রেমিট্যান্সের অর্থে। রপ্তানি আয় দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানোর পর রেমিট্যান্স থেকে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ ব্যয় হতো আমদানি খাতে। বাকি ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ জমা হতো রিজার্ভে। বর্তমানে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কিছুটা কমেছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ফলে এখন রেমিট্যান্সের পুরো অর্থই আমদানি খাতসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় হচ্ছে। রিজার্ভে যোগ হচ্ছে না। যে কারণে রিজার্ভও বাড়ছে না। উল্টো কমে যাচ্ছে। কারণ রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে জরুরি আমদানি ব্যয় বাবদ ডলারের জোগান দিতে হচ্ছে। গত মার্চে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় মিলে আয় হয়েছে ৬৬২ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আমদানি খাতে গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যয় হয়েছে ৭৭২ কোটি ডলার। ঘাটতি হয়েছে ১১০ কোটি ডলার। এ ছাড়া বৈদেশিক ঋণের বকেয়া কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এসব মিলে ডলার সংকট আরও বেড়েছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী, আগামী জুনের মধ্যে সম্ভাব্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে আইএমএফ। ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ঋণের অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে জুনের মধ্যে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ অন্তত ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারে রাখতে হবে। আর সেই শর্ত পূরণে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ৩ হাজার ৯৩ কোটি ডলার। চলতি সপ্তাহে আকুর আমদানি বিল পরিশোধ করার কথা রয়েছে। এতে দেশের রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ২৯ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৯৮১ কোটি ডলারে। আর আইএমএফ’র পদ্ধতি ধরা হলে রিজার্ভ থেকে বিদেশে বিভিন্ন বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ; রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠন; বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে সোনালী ব্যাংককে ধার; পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতে দেয়া অর্থ এবং শ্রীলঙ্কাকে ধারসহ ৮২০ কোটি ডলার বাদ দিতে হবে। এরফলে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়াবে ২১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলারে। এদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাকি আছে প্রায় ২ মাস। এ সময়ের মধ্যে রিজার্ভকে কাক্সিক্ষত জায়গায় নিতে ২৮৫ কোটি ডলারের ঘাটতি পূরণ করতে হবে সরকারকে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রিজার্ভ গননা পদ্ধতি জুনের পর থেকে করা হবে বলে বলা হয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে প্রতি মাসে গড়ে এক লাখের বেশি বাংলাদেশি বিদেশে যাচ্ছেন। কিন্তু ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে বৈধ পথে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৭৭১ কোটি ডলার।

করোনার সময় হুন্ডি ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এতে ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈধ পথে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। একইসময়ে রিজার্ভও পৌঁছে গিয়েছিল সর্বোচ্চ ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলারে। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার পর সক্রিয় হয় হুন্ডি। কমে রেমিট্যান্স পাঠানোর হার। ফলে রিজার্ভও কমতে থাকে।

এদিকে ডলার সাশ্রয়ে আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে নেমেছে ঋণাত্মক প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশে, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৫০ শতাংশ। এ হিসাবে এক বছরে আমদানি কমেছে ৬০ শতাংশ। কিন্তু এরপরেও রিজার্ভ কমে যাওয়ার ধারাবাহিকতা ঠেকানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমদানি বিল মেটাতে ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন প্রায় ৬ কোটি ডলার বিক্রি করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র বলেন, দেশের রিজার্ভ বাড়া-কমার মধ্যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আকু পেমেন্টও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি রুটিন কাজ। এটি নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।

https://mzamin.com/news.php?news=54394