৮ মে ২০২৩, সোমবার, ২:৩৯

বিশ্ব থ্যালাসিমিয়া দিবস আজ

বাংলাদেশে অসংখ্য থ্যালাসিমিয়া রোগী : নেই স্থায়ী চিকিৎসা

বাংলাদেশে প্রচুর থ্যালাসিমিয়া রোগী। বোন ম্যারে প্রতিস্থাপন করলে বেশির ভাগ থ্যালাসিমিয়া রোগীকে বাঁচানো যায়। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েকটি উদ্যোগ নেয়ার পরও বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনের সুফল আসেনি। দেশে প্রতিস্থাপন করলে অনেক কম খরচ করে থ্যালাসিমিয়ার রোগীরা সুস্থ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু দেশে স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই। রক্ত রোগ থ্যালাসিমিয়া নিয়ে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৭ হাজার শিশু জন্ম নেয়। জনসংখ্যার এক কোটি ১০ লাখ মানুষ নিজের অজান্তেই এ রোগের জিন বহন করে চলছে। এটা বংশগত রোগ, সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ নয়।

প্রতি বছর ৮ মে দিবসটি পালন করা হয়। থ্যালাসিমিয়া প্রতিরোধে গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। রোগটি প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি সব পেশাজীবী ব্যক্তি ও সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, গণমাধ্যম, অভিভাবকসহ সচেতন নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

চিকিৎসকরা বলেছেন, থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা আছে, তবে তা অনেক ব্যয়বহুল। রোগীদের প্রতি মাসে এক থেকে দুই ব্যাগ রক্ত লাগে। সহজলভ্য কোনো চিকিৎসা না থাকায় এই রোগ প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য বিয়ে করার আগে সম্ভাব্য বর ও কনের রক্তে থ্যালাসিমিয়ার জিন রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করে বিয়ে করলে অনাগত সন্তানকে থ্যালাসিমিয়া থেকে রক্ষা করতে করা সম্ভব। কারণ বাহক মা-বাবা থেকেই অনাগত সন্তানের দেহে রোগটি আসে। এটা একটি অবহেলিত রোগ। অবহেলার কারণে রোগটির বিস্তার বাড়ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, বিয়ের আগে ভবিষ্যৎ বর-কনের প্রত্যেকের রক্ত পরীক্ষা করার ব্যবস্থাসংবলিত একটি আইন করে দিলে বিয়ে আগে পরীক্ষা করে রোগটি থেকে রক্ষা পেতে পারে। রক্ত নেয়া এবং এর সাথে অন্যান্য ওষুধ ও চিকিৎসা বাবদ বয়সভেদে প্রত্যেক থ্যালাসিমিয়ার রোগীকে মাসে ৭ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, স্বামী-স্ত্রী উভয়েই থ্যালাসিমিয়ার জিন বহন করলে কেবল তখনই সন্তানের থ্যালাসিমিয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সন্তানের থ্যালাসিমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ২৫ শতাংশ, ৫০ শতাংশ হবে থ্যালাসিমিয়া জিনের বাহক এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ সুস্থ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার স্বামী-স্ত্রীর যেকোনো একজন বাহক হলে অনাগত সন্তান ৫০ শতাংশ পর্যন্ত থ্যালাসিমিয়া মুক্ত হয়ে জন্ম নিতে পারে এবং বাকি ৫০ শতাংশ থ্যালাসিমিয়ার জিন বহন করতে পারে কিন্তু রোগটিতে ভুগবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা: এ বি এম ইউনুস জানিয়েছেন, থ্যালাসিমিয়ায় আক্রান্তদের দেহে পর্যাপ্ত লাল রক্ত কণিকা (লোহিত কণিকা) উৎপাদন হয় না। আবার কিছু উৎপাদন হলেও তা দ্রুত ভেঙে যায়। ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তির বেঁচে থাকার জন্য মাসে এক থেকে দুই ব্যাগ রক্ত নিতে হয়। ক্রমাগত রক্ত নেয়ায় শরীরে অতিরিক্ত লৌহ (আয়রন) জমা হয়ে হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, ব্রেইন, হার্টের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয় এবং স্থায়ীভাবে অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে থ্যালাসিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের দেহ থেকে লৌহ দূর করে দেয়ার জন্য দৈনিক ওষুধ সেবন করতে হয়। এসব ওষুধ খুবই ব্যয়বহুল। চিকিৎসা না করালে ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু হতে পারে। আবার অনেকেই চিকিৎসার মাধ্যমে ৫০-৫৫ বছর বেঁচে থাকতে পারেন। দেহে পর্যাপ্ত লোহিত কণিকা না থাকায় এবং অন্যের রক্ত নেয়ায় রোগী দ্রুত বিভিন্ন জীবাণুতে কাবু হয়ে পড়ে। রক্তে অতিরিক্ত আয়রন থাকলে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সমস্যাটা দূর করার জন্য গ্রোথ হরমোনের মাত্রা শনাক্ত করে চিকিৎসা দিতে হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৭ শতাংশ মানুষ থ্যালাসিমিয়া রোগের বাহক। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ হাজার। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, থ্যালাসিমিয়ার রোগীরা পর্যাপ্ত চিকিৎসা পেলে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

অধ্যাপক ইউনুস বলেন, থ্যালাসিমিয়ার বাহক স্বামী-স্ত্রী সন্তান নিয়ে নিলেও গর্ভের শিশুর প্রিনেটাল ডায়গনসিস করে জানা যায় শিশুটি থ্যালাসিমিয়া নিয়ে জন্ম নেবে না বাহক হিসেবে জন্ম নেবে। থ্যালাসিমিয়া নিয়ে জন্ম নিলে তখন বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিয়ে শিশুটিকে জন্ম দিতেও পারেন অথবা অন্য ব্যবস্থা করতে পারেন। গর্ভের ভ্রুণের মধ্যে থ্যালাসিমিয়ার জিন থাকলে পিতামাতার সম্মতিতে মেডিক্যাল অ্যাবরশন করানো হলে ভবিষ্যতের সীমাহীন কষ্টভোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সহজেই। এটি গর্ভের ১০ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে করা হয়ে থাকে।

পাকিস্তান, ইরান ও সাইপ্রাসে বিয়ের আগে সরকারিভাবে থ্যালাসিমিয়া পরীক্ষা করানো হয়ে থাকে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে রোগটি নিরাময় করা সম্ভব। কিন্তু খুবই ব্যয়বহুল ও ঝামেলাপূর্ণ এ কাজটি। ভাইবোনের মধ্যে রোগীর মজ্জার সাদৃশ্য থাকতে হয়। এর সম্ভাবনা ৫ থেকে ১০ শতাংশ মাত্র। একটি বয়সের পর প্রক্রিয়াটি খুবই ঝূঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে এবং নিরাময়ের হারও কম হয়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ায় অনেক সময় ১০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়ে থাকে। এ রোগটি প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বিয়ের আগে রোগীর রক্ত পরীক্ষা করা। সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যানটেশন মেশিন বসানো হয়েছে। কিন্তু তা বেশি দূর এগোতে পারেনি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/746275