৮ মে ২০২৩, সোমবার, ২:২৯

‘এই মানুষের ভিড়ে আমার সেই মানুষ নাই’

-ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

বাংলাদেশের বয়স বায়ান্ন চলছে। ইতোমধ্যে নানান শিল্প উদ্যোগে ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এর অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। দেশটি কৃষি ও ট্রেডিংনির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে অগ্রসরমান। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখাতে গিয়ে বিদেশী কঠিন শর্তেও ঋণ ও চুক্তির মধ্যে জড়িয়েছে এবং সাম্প্রতিককালে ভূরাজনীতির বিবদমান পক্ষগুলোকে হাতে রাখার মতো স্বাভাবিক শাঁখের করাতের মুখে দেশ, সমাজ ও অর্থনীতি। বাস্তব এ পরিস্থিতি চলমান এবং এর ভবিষ্যৎ অভিঘাত মোকাবেলায় যে জনসম্পদ ও পরিবেশ পরিস্থিতি প্রয়োজন, যে ধরনের জনসম্পদের সক্রিয় অংশগ্রহণে ও উন্নয়নঅনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির বদৌলতে জাপান দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের ধূলিসাৎ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছিল সেই জনসম্পদ, ন্যয়-নীতিনির্ভর জবাবদিহিমূলক পরিবেশই একমাত্র ভরসা।

বাংলাদেশ জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ একটি দেশ। সে কারণে স্বাভাবিকভাবে দেশের কর্মক্ষম জনগণকে কর্মকুশল দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করার অনিবার্যতা দেখা দিয়েছিল দু’দশক আগে থেকে। কেননা, ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ সৃজনশীল কর্মক্ষম জনসমষ্টির আওতায় চলে এসেছে, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট নামে পরিচিত। সনাতন শর্তানুযায়ী ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট মূলত তিন দশক পর্যন্ত সৃজনশীল ও উন্নয়ন অভিসারী অভিযাত্রায় থাকে। ইতোমধ্যে তার এক দশকের বেশি সময় চলে গেছে, সামনে আরো দেড়-দুই দশক বাকি আছে। এ সময়ের মধ্যে বিদ্যমান কর্মোপযোগীদের উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করতে না পারলে বা তাদের উপযুক্ত কর্মসম্পাদনে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে কিংবা তাদের জন্য উপযুক্ত কাজ ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে তারা অলসতায় শয়তানের কর্মশালায় যোগ দিতে পারে কিংবা অকর্মণ্যতায় হতাশায় নিমজ্জিত হতে পারে, যে পরিস্থিতিতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে। কেননা, সমাজে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেলে উৎপাদনশীলতায় বা জিডিপিতে তাদের অবদান বঞ্চিত হয় দেশ এবং তারা নিজেরাই নিজেদের, পরিবারের ও দেশের জন্য বোঝা বা বিপদের বা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেই ক্ষতির ধকল কাটিয়ে উঠতে জাতির জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর সময় এবং এর জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিতে হবে বিশেষ মাশুল।

বিগত বায়ান্ন বছরে বাংলাদেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় এ দেশের জনগণকে বিশেষ করে যুবসমাজকে এখনো পর্যাপ্ত ও যথাযথ দক্ষ জনসম্পদে বা প্রশিক্ষিত লোকবল হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। যার জন্য এ দেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছে অদক্ষ শ্রমিক আর বিদেশের দক্ষ জনবল এ দেশের মধ্য ও উচ্চতর পদগুলোতে বেশি বেতনে নিয়োজিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় সমাপনকারী ডিগ্রিধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু তাদের দেশের উদীয়মান শিল্পে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগযোগ্য হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বাংলাদেশী কর্মী ও ব্যবস্থাপক পর্যায়ের জনসম্পদের মধ্যে চিহ্নিত সীমাবদ্ধতাগুলোর মধ্যে আছে- ১. তাদের উৎপাদন কিংবা সেবা খাতে করিৎকর্মা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করা বা উপস্থাপন বা তুলে ধরার মতো প্রযোজ্য প্রায়োগিক ভাষা ও জ্ঞানের অভাব; ২. রয়েছে সৃজনশীল তথা উদ্ভাবনী শক্তি প্রকাশে, প্রয়োগে সংশয়, সঙ্কোচ তথা অপারগতা; ৩. প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কর্মদক্ষতা বা কার্যকর জ্ঞানের অভাব; ৪. উপযুক্ত বাজার সৃষ্টি বা খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ, নিষ্ঠা ও দক্ষতার অভাব; ৫. বাজারজাতকরণে নৈপুণ্য প্রদর্শন, দক্ষতা, আগ্রহ ও তৎপরতায় ঘাটতি; ৬. তারা বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবস্থাপনায় অপটু; ৭. ক্রয়-বিক্রয় পরিচালনায় পরিবেশনে, উপস্থাপনে, নেগোসিয়েশনে নিষ্ঠার অভাব; ৮. সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয়াদি ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং সেসব মোকাবেলা তথা সমাধানের পথপরিক্রমায় সাহস ও প্রজ্ঞার অভাব; ৯. লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রায়োগিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও ১০. ব্যবসায়-বাণিজ্য, বিনিয়োগ-উৎপাদন ক্ষেত্রে উদ্যম ও উদ্যোগকে টেকসইকরণে নিষ্ঠার অপ্রতুলতা ইত্যাদি। আর এর সবই অনুকূল পরিবেশ সৃজনের ওপর নির্ভরশীল ।

বিভিন্ন পর্যালোচনায় বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশী তরুণ উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের অভাব, ক্ষেত্রবিশেষে অনাগ্রহ। দেশের শিক্ষিত ও সামর্থ্যবান সক্ষম শিল্পপরিবারের তরুণ প্রজন্ম বিদেশে গিয়ে ভালো করছে অথচ তারা দেশে ফিরতে চাচ্ছে না। তারা বলছে, দেশে তাদের অবস্থান কিংবা কোনো উদ্যোগ গ্রহণের অনুকূল পরিবেশ নেই। পুঁজিপাচারের মতো মেধাপাচারের দুর্বলতায়, প্রায়োগিক জ্ঞানের নিম্নগামিতায়, প্রশিক্ষণ ও অধিক শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহের অভাব, সৃজনশীল পৃষ্ঠপোষকতা দানের ঘাটতি বা কমতি রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য উঠতি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে টিকে থাকা কিংবা অধিকতর যোগ্যতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো উপযুক্ত ও দক্ষ জনবলের যেমন প্রয়োজন; তেমনি টেকসই ও লাগসই প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং সমন্বয়ে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তার সাথে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকুশলতা। এ প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার গুণগত মান কমে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ডে নতুন নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে, সেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে তা মোকাবেলা করতে পর্যাপ্ত ও উপযুক্ত লোকবলের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।

এ সহস্রাব্দের শুরু থেকে বলতে গেলে বিশেষ করে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বাস্তবায়ন যখন শুরু হয় তখন থেকে বাংলাদেশে দক্ষ জনবল বা মানবসম্পদ তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়ে নানা উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। দাতা সংস্থার পরামর্শ ও অর্থায়নে ইতোমধ্যে বেশ কিছু সংস্থা, প্রকল্প, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গৃহীত হলেও দৃশ্যমান দক্ষ জনবল সেভাবে যে গড়ে উঠেনি তা বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশে কর্মসৃজন, বিদেশে দক্ষ জনবল পাঠানোর এবং এ দেশে বিদেশীদের নিয়োজন-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকে প্রতিভাত হচ্ছে। বিগত দেড় দশকে বরং দেখা গেছে, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ঊর্ধ্ব ও মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপক, পরামর্শক, সংগঠন ও কর্মী এসে বাংলাদেশে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন আর্থিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত হয়েছে। ফলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে প্রত্যাবাসিত হচ্ছে। অপর দিকে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে দক্ষের পরিবর্তে অদক্ষ শ্রমিক পাঠানোর মাত্রা বেড়েছে। যদিও এ দেড় দশকে দেশে পরীক্ষায় পাসনির্ভর প্রচুর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে বা শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে; কিন্তু উঠতি বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মতো পর্যাপ্ত ও কার্যকর জ্ঞান দিয়ে তাদের নিয়োগ করা যায়নি এ অনুযোগে যে, তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর কর্মীদের তুলনায় চটপটে, পটু, প্রায়োগিক জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া থেকে পেছনে রয়েছে। এরূপ অদক্ষ, অর্ধশিক্ষিত জনসম্পদ বছর বছর তাদের চাকরির বয়স খুইয়ে স্থায়ী বেকারে পরিণত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের যে কর্মসম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে সেখানে উপযুক্ত দেশীয় লোকবল সংস্থান করা যাচ্ছে না; অথচ সেগুলো বিদেশীদের দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শিল্প একটি অতি সম্ভাবনাময় শ্রমিকনির্ভর শিল্প। সেখানে মধ্য পর্যায়ের বেশির ভাগ ব্যবস্থাপক, পরিচালক, নকশাকার হিসেবে নিয়োজিতরা বিদেশী। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, গার্মেন্টের বায়াররা প্রতিবেশী দেশে (যারা আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী) বসে সে দেশের লোক নিয়োগ না করলে আমাদের বাজার হারাতে হবে- এ ধরনের একটি অঘোষিত হুমকি রয়েছে। এর ফলে দেশী শিক্ষিত বেকারকে কর্মসংস্থানের চাহিদার করণে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় এবং চাকরি না পেয়ে বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণরা হতাশায় নিমজ্জিত। বছর কয়েক আগে কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সেই হতাশার বেদনা বাঙময় হয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। একই সময়ে দেশের টেকনিক্যাল শিক্ষার পরিবর্তে সাধারণ শিক্ষার জয়যাত্রা অব্যাহত থাকায় দক্ষ জনবল সরবরাহের পরিস্থিতি এমন একটি নেতিবাচক পর্যায়ে যাচ্ছে যে, দীঘমেয়াদে তাতে এক করুণ ও আত্মঘাতী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আশঙ্কা প্রকাশ পাচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ডেমোগ্রাফিক ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে।

জনসম্পদ উন্নয়নে বিদ্যমান এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা ও উন্নত পর্যায়ে উত্তরণ শুধু জরুরি নয়; অনিবার্যও বটে। এখনই যদি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দেয়া না হয়; তাহলে আগামী ১৫ বছরেও সেই দক্ষ জনবলের সাক্ষাত মিলবে না। ততদিনে বর্তমানে বিদ্যমান বেকার ও অদক্ষ শিক্ষিত জনসম্পদ উপরে ও নিচের জন্য জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকবে। ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান পর্যায়ে বিদেশীদের নিয়োগ অব্যাহত থাকলে বা রাখলে দেশের চাকরি বাজার দেশীয়দের জন্য আরো অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। এহেন পরিস্থিতি থেকে কার্যকরভাবে পরিত্রাণ পেতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান
mazid.muhammad@gmail.com 

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/746137