৭ মে ২০২৩, রবিবার, ৩:৫৬

অসময়ে নদীভাঙন

ভাঙন নদী পাড়ের বাসিন্দাদের কাছে এক আতঙ্কের নাম। নদীভাঙন একেবারেই বিধ্বংসী, সবচেয়ে বড় দুর্যোগ। ঘূর্ণিঝড়ে ঘর উড়ে গেলেও ভিটেটুকু থাকে। বন্যায় ফসল ভেসে গেলেও জমিটুকু থাকে। আগুনে সব পুড়ে গেলেও ছাইটুকু থাকে। কিন্তু নদীভাঙনে সব শেষ হয়ে যায়। নদীভাঙনে সকাল বেলার আমির সন্ধ্যাবেলাতেই একেবারে নিঃস্ব ফকির হয়ে যায়।

বর্ষা এলে প্রতিবছরই দেশে বিস্তীর্ণ এলাকা নদীভাঙনের শিকার হয়। এতে বসতভিটা জায়গা-জমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয় হাজার হাজার পরিবার। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদরাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের এক জরিপে বলা হয়, ভাঙনে প্রতিবছর প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়।

বর্ষায় নদীভাঙন স্বাভাবিক হলেও অসময়ে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে ভাঙন নদী পাড়ের মানুষ দিশেহারা। দেশের কয়েকটি জেলায় এ বছর অসময়ে ভাঙন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর এবং টাঙ্গাইলে যমুনার ভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার। বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীর গতি রোখার চেষ্টার কারণে নদীভাঙন ঘটে। নদীতে বাঁধ দেয়া, অপরিকল্পিতভাবে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা নদী ভাঙনের এক অন্যতম কারণ। নদীর পাড়ের ঘাস, গাছ, কাশবনসহ অন্যান্য বন উজাড় করে ফেললে মাটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পানির তোড়ে ভাঙন সৃষ্টি হয়। এছাড়া অপরিকল্পিতভাবে নদী খনন বা ড্রেজিংয়ের কারণে ক্ষতির শিকার হয় নদী। এ ছাড়া অবৈধভাবে বালু উত্তোলন এবং আরেকটি বিষয় হচ্ছে দুর্নীতি। নদীভাঙন রোধে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, যে প্রক্রিয়ায় এবং যে ধরনের দ্রব্য ব্যবহার করে নদীর পাড় মজবুত করতে বলা হয়, দুর্নীতি করতে গিয়ে তা করা হয় না। ফলে সরকারি উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবে তা তেমন সহায়ক হয় না।

অসময়ে নদী ভাঙনের তথ্য নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট নিচে তুলে ধরা হলো।
বৃহত্তর ফরিদপুরের নদীভাঙন এলাকা ঘুরে রিপোর্ট করেছেন আমাদের ফরিদপুর জেলা সংবাদদাতা আনোয়ার জাহিদ। তিনি জানান, বৃহত্তর ফরিদপুরের তথা ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, জেলায় ভয়াবহ নদীভাঙনে প্রায় তিন লাখ পরিবার গৃহহীন হয়ে এখনও চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। নদী ভাঙনকবলিত মানুষের দিক তাকালে মনে হয় এর যেন জন্মলগ্ন থেক অভিশপ্ত। এদের দুঃখ-কষ্ট দেখার যেন কেউ নেই। বৃহত্তর ফরিদপুর ৪টি জেলার কমপক্ষে ৭/৮টি উপজেলার তথা ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন, সদরপুর, আলফাডাঙ্গা মধুখালী, রাজবাড়ী সদর, মাদারীপুর শিবচর, শরীয়তপুর ডামুইড্যা, ঘোষাইরহাট, এলাকায় সরেজমিন প্রতিবেদনকালে ওই এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, উল্লেখিত এলাকায় কারো কারো বাড়ি ১০ বার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। ৪টি উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে বহু বাড়িঘর, স্কুল, মাদ্রাসা, মন্দিরসহ হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি। বৃহত্তর ফরিদপুরের পদ্মা আড়িয়াল খাঁ, মধুমতি, নদীর ভাঙনে গত ৪০ বছরে প্রায় তিন লাখ পরিবার গৃহহীন হয়েছে বলে জানা যায়। ওই সকল পরিবার যে যেখানে পারছেন তাদের সুবিধা মতো জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন।

ফরিদপুর সদরে গত ২০০০ সালের এক জরিপে উঠে আসে ফরিদপুর সদর উপজেলা, সদরপুর, চরভদ্রাসন, এই তিন উপজেলায় নদীভাঙনে ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০০ গত ২৩ বছরে তা বেড় কয়েকগুন হয়েছে। ২০০০ সালের দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রয়াত মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের দপ্তরের হিসেব মতে ওই সময় ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ। এখন তাও বেড়ে ডবল হয়েছে। এমনটাই শোনা যায়। এর মধ্যে ফরিদপুর সদর থানার ডিক্রিচড় ইউনিয়নের ৮/১০ গ্রাম, নর্থচানেল ইউনিয়নের। ৮/৯টি গ্রাম সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

যতদূর জানা গেছে, চরভদ্রাসন উপজেলার চরহরিরামপুর ও গাজীরটেক ইউনিয়নের অব্যাহত নদীভাঙনে ৪টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র একটিসহ অপর একটি ইউনিয়নের সামান্য কিছু অংশ আছে। এর মধ্যে চরঝাউকান্দা ইউনিয়নের ৯৮ ভাগ এবং চরসালেপুর ইউনিয়নের ৮৫ ভাগ পদ্মা বিলীন হয়ে গেছে।

ফরিদপুর সদর থানার নর্থচানেল ইউনিয়নের ইউসুফ মাতুব্বর ডাঙ্গী ও উস্তাডাঙী এলাকায় ব্যাপক নদী ভাঙনে অসময়ে নতুন করে প্রায় ৫০ হাজার একর ফসলি জমি নদীর গর্ভে বিলীন হয়েছে। এ ভাঙনে কমপক্ষে ৩ শত পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ছে। তীব্র ভাঙনের হুমকির মুখে পড়ছে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নিড়মিত গোলডাঙ্গী ব্রিজটি, দুটি সরকারি স্কুল, একটি হাসপাতাল ও একাধিক মসজিদ, মাদ্রাসা এবং প্রায় ৪ কিলোমিটার সরকারি পাকা সড়ক।

বৃহত্তর ফরিদপুরের রাজবাড়ী জেলার মধ্যে রাজবাড়ী সদর উপজেলা এবং গোয়ালন্দ উপজেলাটি পদ্মানদী সংলগ্ন তথা দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। পদ্মাতীরের নদীভাঙনে দীর্ঘ ৪০ বছরে যন্ত্রণায় থাকলেও পদ্মা কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই চলছে খেলা। এলাকার হাজার হাজার ভূস্বামীর ও জমি-জিরাত রাক্ষসী পদ্মা গ্রাস করছে। পদ্মার চড়েও এখন তাদের ঠাঁই নেই। নদী ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ তাদের আত্মীয়-স্বজনহারাদের জমিতে, কেউ রাস্তার পাশে, কেউ সরকারি জায়গা, কেউ বস্তিঘরে, কেউবা সরকারের আশ্রয়ণে। রাজবাড়ী সদর থানার চরধুঞ্চী, দিলিসপুর, বড়চর, বেনীনগর, মৌকূড়ী, আমবাড়িয়া, মালিকান্দার এলাকার নদীভাঙনে এবং বড় বড় চাপ নিয়ে সবুজের ধানক্ষেত নদীতে দৃশ্য মনে করে বহু মানুষ এখনও কাঁদে। এই চিত্র গোয়ালন্দের ফেরীঘাট এখনও দৃশ্যমান। ঢাকা-মানিকগঞ্জসহ উওরাঞ্চল থেকে লঞ্চ অথবা ফেরিতে আসলে এই চিত্র এখনও চোখে পড়ে। এখানে শত শত নদীভাঙনের শিকার বহু মানুষ এখন গ্রামগঞ্জে তাদের আত্মীয়স্বজন কেউ সরকারি জায়গায় বাড়িঘর তুলে কোনো রকম বেঁচে আছেন। অপরদিকে, মাদারীপুর উপজেলার সদর থানার কুমার নদীতে তেমন কোনো ভাঙন লক্ষ্য করা না গেলেও শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ও কাওরাকান্দি গ্রাম দুটিতে ব্যাপক নদীভাঙন এখনও অব্যাহত আছে। ওই দুটি গ্রাম শিবচর উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে প্রায় ৬/৭ শত পরিবার তাদের ভিটেবাড়ি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলছেন। নদীভাঙনের কবলে পড়ে বৃহত্তর মাদবরচড় হাট, গাবতলা হাট, জমিদার বাড়ি, মাতবরচড় বাজারসহ বিশাল দুটি বাজার এখন পদ্মার বুকে। এখনও ভাঙন কম-বেশি অব্যাহত আছে।

এছাড়াও শরীয়তপুর জেলায় বিগত ৩০ বছর যাবৎ একাটানা ভাঙনে ৪০/৫০ গ্রাম সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এলাকার ৮০ বছর বয়সি মো: দিন ইসলাম ইনকিলাবকে জানান, শরীয়তপুর জেলাটি মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত। ডাম্যুডা ও ঘোসাইর হাট উপজেলা দুটি মেঘনা নদীর তীরবর্তী। এই নদীর ভাঙন এত তীব্রতরÑ ভাষায় বোঝানো যাবে না। তিনি বলেন, ১৯৭০ সাল থেকে ২০০৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আমি নিজ চোখে ভাঙন দেখেছি। তাতে চোখের সামনে ৬০টি গ্রাম চলে গেছে মেঘনায়। ১৯৫-৯৬ সাল পর্যন্ত ৮০০০ হাজার বসত ভিটা, ৪/৫ ইউনিয়নের ৫ হাজার পরিবার, ১৫ কিমি. পাকা সড়ক, ১০ বর্গকিলোমিটার ফসলি জমি, ৫০ হাজার একর মাটাম জমি আমি নিজে বিলীন হতে দেখেছি। এখন বর্তমান ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করার বয়স আমার নেই।

টাঙ্গাইল থেকে আতাউর রহমান আজাদ জানান, যমুনা নদীর পাড়ঘেঁষা টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ধুবাড়িয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে অসময়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদী পাড়ের বাসিন্দারা। সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃশ্ব হয়েছেন অসংখ্য পরিবার। শত প্রতিশ্রুতির পরেও কেউ এগিয়ে আসেনি নদীর পাড়ের এসব অসহায় পরিবারগুলোর পাশে। তবে, উপজেলা প্রশাসন নদীভাঙনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন।

চৈত্র-বৈশাখ মাসের শুষ্ক মৌসুমেও নদী তীরবর্তী ধুবড়িয়া ইউনিয়নের বলরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের মুখে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে দুই একদিনের মধ্যে চলে যাবে যমুনায়। এরই মধ্যে বিভিন্ন গ্রামে শুরু হয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। রাস্তা, কালভার্ট ও বহু ঘরবাড়ি, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা যমুনা নদীর গর্ভে চলে গেছে। বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি হারিয়ে মানুষ দিশেহারা। এলাকাবাসীর দাবি নদীভাঙন প্রতিরোধে স্থায়ী গাইড বাঁধ নির্মাণের।

বলরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক মনিরুল ইসলাম বলেন, ভাঙন এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই বলরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। এতে এলাকার শিশুদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই স্কুলটি রক্ষায় নদীভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি স্কুল শিক্ষকের। ধুবড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান শাকিল জানান, অসময়ে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। বলরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ভাঙনের মুখে। স্কুলটি রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহতি করা হবে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওয়াহিদুজ্জামান জানান, নদী ভাঙনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহতি করে ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

https://dailyinqilab.com/national/article/572737