৭ মে ২০২৩, রবিবার, ৩:৫৪

মোবাইল আসক্তিতে বিপথগামী শিক্ষার্থীরা

ডেন্টাল প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রাইয়ানা। তার বেশির ভাগ সময় কাটে মোবাইলে। পড়াশোনা বা অন্য কোনোকিছুই ভালো লাগে না। কিছুক্ষণ পরে পরে ঢুঁ মারেন ফেসবুকে। এরপরই দীর্ঘ সময় কাটতে থাকে অনলাইনে। সিআইডি’র সাইবার সাপোর্ট সেন্টারে অভিযোগ করে রাইয়ানা বলেন, দিনের অনেকটা সময় আমি ফেসবুকে কাটাই। কিছুদিন পরই আমার পরীক্ষা। কিন্তু লেখাপড়ার কোনো চিন্তা আমার নেই। পড়ার আগে অটোসাজেশন দিই ঠিকই, কিন্তু একটু পরই ঢুঁ মারি ফেসবুকে। তারপর সেখানেই আটকে যাই।

এভাবে একসময় রাত শেষে ভোর হয়ে যায়। কিন্তু পরে আর পড়ার সময় থাকে না। যখনই আমি কোনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি তখনই ফেসবুককে সঙ্গী করে নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রতিনিয়ত একজন মানুষ ফেসবুক বা অনলাইনে বিভিন্ন ছবি, ভিডিও দেখে তখন অবচেতনভাবেই এর সঙ্গে তার নিজেকে তুলনা করতে থাকে। একসময় সে ভয়ঙ্কর নেশার মধ্যে চলে যায়। বাস্তব জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। এতে ব্যবহারকারীর মন-মানসিকতা, শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফেসবুকে ছবি পোস্ট দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর দেখে কয়টি লাইক পড়েছে, কয়টি কমেন্ট করেছে বা সেখানে কে কি বলছে, কেউ নতুন করে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে কিনা, কোনো বন্ধু তাকে ব্লক করেছে কিনা এগুলো ফলো করে। গেমসহ বিভিন্ন সাইটে থাকে তার বিচরণ। ১৬-২২ বছরের বয়সীদের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতাটা বেশি। এসব আসক্তি যখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয় তখন তার আর কোনো ক্যারিয়ার থাকে না। একটা সময় পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ প্রতিনিয়ত ডিভাইস আসক্ত হয়ে পড়ছে। একাডেমিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অনৈতিক কাজ, অপরাধ, অগ্রহণযোগ্য ও পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছে। ইভটিজিং, দলগত ধর্ষণ, আত্মহত্যা ও খুনের মতো ঘটনাগুলো ঘটছে।

ফেসবুক বা এ সকল ডিভাইস মানুষের মনস্তাত্ত্বিক আচরণে কতোটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেক্ষেত্রে মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, কেউ যদি প্রতিদিন ৩ ঘণ্টার অধিক ফেসবুক বা অনলাইন ব্যবহার করে তাহলে প্রাথমিক আসক্তির মধ্যে চলে যায়। এটা যদি ৩ মাসের অধিক চলতে থাকে তাহলে সেটি আসক্তির দ্বিতীয় পর্যায়ে চলে যায় এবং এটি ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকলে সেটি আসক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়।

সম্প্রতি রয়াল সোসাইটি অব পাবলিক হেলথ একটি জরিপ চালায় ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী দেড় হাজার কিশোর-কিশোরীর উপর। এতে দেখা যায়, ফেসবুক, স্নাপচ্যাট এবং ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের মনে সবচেয়ে বেশি হীনমন্যতা এবং দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের তরুণ-তরুণীদের অর্ধেকই বলেছে, ফেসবুকের কারণে তাদের মানসিক দুশ্চিন্তা, অশান্তি আর উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। দুই তৃৃতীয়াংশ বলেছে, ফেসবুকের কারণে সাইবার বুলিং বা অনলাইনে অপমান-হয়রানির প্রবণতা আরও গুরুতর আকার নিয়েছে।

সূত্র জানায়, আগে এটি স্বাভাবিক পর্যায় ছিল কিন্তু বর্তমানে অত্যন্ত ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। যে সকল দেশগুলো বুঝতে পেরেছে তারা সোস্যাল মিডিয়া বিশেষ করে তরুণরা ফেসবুক ব্যবহার করতে পারবে কিনা সেক্ষেত্রে নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমরাও ব্যবস্থার কথা বলছি কিন্তু আমাদের দেশে কোনো কিছু চূড়ান্ত রকমের বিপর্যয় বা পরিণতি না ঘটলে আসলে জ্ঞান ফিরে আসে না, বাস্তবতা বুঝতে পারি না। আমাদের এখানে অনেক শিক্ষার্থী দিনের একটা বেশি সময় সোস্যাল মিডিয়ার পেছনে ব্যয় করে। পড়াশোনার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বা জায়গাগুলো ধ্বংস করে। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। যে বয়সে তার বন্ধুত্ব বোঝার কথা না সেই বয়সে তার হাতে ডিভাইস উঠছে। অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনাকে খুব সহজ করতে গিয়ে সস্তা করে ফেলেছি। এই সস্তা করার পরিণতি কি হতে পারে আগামী ১০-১৫ বছর অপেক্ষা করলে আমরা বুঝতে পারবো।

শুধু রাইয়ানা নয়, এইরকম অসংখ্য মানুষ অনলাইনে আসক্তি হয়ে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতিরিক্ত অনলাইনে আসক্তির কারণে বাড়ছে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক দুশ্চিন্তা, হয়রানি ও উৎকণ্ঠা। উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র দিয়াম বলেন, পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না। বেশির ভাগ সময় ফেসবুকে সময় কাটাতে ভালো লাগে। এখন মনে হচ্ছে এটা অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছে আমার উপরে। বর্তমানে পড়তে বসলেই নেতিবাচক চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, কোনো ধরনের বিধি-নিষেধ ছাড়াই যে যেভাবে খুশি ফেসবুক ব্যবহার করছে। এটি তরুণ প্রজন্মকে কোনো শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে পারেনি। এমনকি পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও না। এই আসক্তি মানুষের মনোবৃত্তি ও বুদ্ধিকে প্রভাবিত করে। শিক্ষার্থী বা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দিনের অধিকাংশ সময় মোবাইলে ফেসবুকসহ সোস্যাল মিডিয়ার অন্যন্যা মাধ্যমগুলো ব্যবহার করছে। সেখানে নানা ভালো-মন্দ আলোচনা চলে। এসব আলোচনায় একাডেমিক আলোচনা তো নেই-ই বরং নন-একাডেমিক আলোচনা হয়। এটি কখনো কখনো গোপনীয়ও হয়। অল্প বয়সে এ সকল কনন্টেট গ্রহণ করার তো ক্ষমতা তাদের থাকতে হবে। তখন একাডেমিক পাঠ্যপুস্তকের প্রতি তাদের মনোযোগ হারায়। তিনি বলেন, এ সকল পরিস্থিতি পরিবারগুলো বুঝতে পারছে কিন্তু রাষ্ট্র বুঝতে পারছে কিনা সেটাই মূল বিষয়। ভারত, চীনসহ অসংখ্য দেশে শিক্ষার্থীরা ফেসবুক ব্যবহার করতে পারে না। আবার কোনো কোনো দেশ আছে কিছু কিছু অ্যাপস ব্যবহার করা একেবারেই নিষিদ্ধ। একজন নাগরিক বা শিক্ষার্থীকে তৈরি করতে গেলে রাষ্ট্রের কিছু বিধি-নিষেধ নিয়মনীতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। আমাদের নিয়মের মধ্যে নানারকম অনিয়ম হয়। এভাবে একটা জেনারেশনকে তৈরি করা যাবে না বরং ধ্বংস করা যাবে। আর আমরা সেই ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছি। এ সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারের কঠোর হতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তানিয়া রহমান বলেন, কৌতূহলবশত যেকোনো আসক্তি প্রথমে তৈরি হয়। যেকোনো জিনিস সম্পর্কে জানতে চায়। কিন্তু যখন এই কৌতূহলটা বাড়তে শুরু করে এবং অভ্যাসে পরিণত হয়, সেই অভ্যাস থেকে এটি আসক্তিতে পরিণত হয়। মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে হয়তো মোবাইল বা অনলাইন ব্যবহার করে। কিন্তু এখন দেখা গেছে এই অপরিহার্যতাকে অতিক্রম করে আমরা আসক্ত হয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, একসময় এটি একটি নেশার মধ্যে চলে যায়। অন্যেরা ফেসবুকে বা অন্যান্য সাইটে কি করছে, নতুন কি আসছে, কি আপডেট হচ্ছে এই জিনিসগুলো তাকে আকৃষ্ট করে বেশি। রাতের বেলা ফোন স্ক্রল না করলে ঘুমাতে পারছে না, ঘুমের আগেও মনে হচ্ছে এটা দেখি ওটা দেখি। এই ক্ষতি থেকে মুক্তি পেতে জোর করে হলেও নিজেকে নিজে কাউন্সিলিং করা উচিত। সেটা পসিবল না হলে চিকিৎসকের কাছ থেকে কাউন্সিলিং নেয়া উচিত। মানুষের ব্রেনসহ শরীরের সমস্ত পার্টগুলোকে বিশ্রাম দেয়া দরকার। সেটা না করে সেই সময়টায় মোবাইল ধরে ঘাটাঘাটি করে। একসময় ডিজ-অর্ডারের পর্যায়ে চলে যায়।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, তরুণ-তরুণীরা অনেক ক্ষেত্রে এখন মোবাইল বেশি ব্যবহার করছে। এরমধ্যে অনেকে এটা পজিটিভ আবার কেউ নেগেটিভ ওয়েতে ব্যবহার করছে। পজিটিভ সাইটগুলোতে গিয়ে তারা অনেক ধরনের একাডেমিক তথ্য সংগ্রহ করে। আবার অযাচিতভাবে সোস্যাল মিডিয়া, টুইটার, ইউটিউব ব্যবহার করে সময়ের অপচয় করছে। কীভাবে সময় চলে যাচ্ছে সেটি কিন্তু তারা নিজেরাও বুঝতে পারছে না। এমনকি এটি ব্যবহার করার পরে অনেক সময় আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়। বর্তমান সময়ে এটি ব্যবহারের থেকে তরুণ-তরুণীরা বেশি অপব্যবহার করছে। পরিবার ও শিক্ষকদের বড় একটা ভূমিকা রয়েছে। বই পড়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক চর্চা করে তাহলে কিন্তু এই মোবাইল আসক্তি থেকে সে সহজে বেরিয়ে আসতে পারবে। তিনি বলেন, ১৩-১৯ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েরা কিন্তু খুব আবেগী। সোস্যাল মিডিয়াতে বিচরণ করে বিপদে না পড়লে কিন্তু এ সকল বিষয়গুলো বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব বা অন্যান্য কারো সঙ্গে শেয়ার করে না। সবসময় নিজের ভেতরে বিষয়গুলো রাখার চেষ্টা করে। এই বিষয়গুলো নিয়ে বাবা-মায়ের উচিত তার সন্তানদের সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনা করা। শিক্ষার্থীরা রেজাল্ট খারাপসহ অনলাইনে বুলিং ও হ্যারেজমেন্টের স্বীকার হচ্ছে। ১৮ বছরের নিচে যারা তাদের তো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলার কথা নয়, তারপরেও কিন্তু সে খুলছে। বাবা-মা-ই তাকে পরিবারের সদস্যদের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম হাতে তুলে দিচ্ছে। সে কিন্তু সেই সিমের মাধ্যমে ফেসবুক খুলছে। আমাদের সিআইডি সাইবার সাপোর্ট সেন্টারে প্রতিদিনই অনেকে ফোন করে মোবাইল ও অনলাইনে আসক্তি বা বিভিন্ন সমস্যার কথা জানায়। আমরা তাদের অনেক সময় ফোনে পরামর্শ দেই।

https://mzamin.com/news.php?news=54228