৪ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:২০

অর্থনীতির দুই সূচকে ভাটা শর্তপূরণ কঠিন হবে

দেশের অর্থনীতির দুই সূচকে ভাটার টান লেগেছে। প্রতিবছর ঈদে প্রবাসীরা বেশি অর্থ পাঠালেও এবারের চিত্র ভিন্ন। অন্যদিকে টানা দুই মাস কমে গেছে রপ্তানি আয়। বৈদেশিক মুদ্রার জোগানের প্রধান দুই সূচকে টান পড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন বা রিজার্ভ নিয়ে ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণ করা কঠিন হয়ে যাবে। আগামী মাস জুনেই রিজার্ভ ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। এটি চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংককে রিপোর্টিংয়ের মান বাড়াতে আগামী জুনের মধ্যে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়ন শুরু করতে হবে। পাশাপাশি ব্যবহারযোগ্য প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের সময় যে ছোট-বড় ৩৮টি শর্ত দিয়েছে, এটি তার মধ্যে অন্যতম। আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, নিট রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ানো হবে, যাতে ২০২৬ সালের মধ্যে নিট রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের আমদানি দায় মেটানো যায়।
আইএমএফ নিট রিজার্ভের সর্বনিম্ন সীমাও বলে দিয়েছে। এটা জুনে ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৫.৩১ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬.৮১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে।

কিন্তু সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত মঙ্গলবার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে। এদিন ডলার বিক্রির দর আরো এক টাকা ৫০
পয়সা বাড়িয়ে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সায় পাঁচ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বর্তমানে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৩০.৯৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি সপ্তাহের শেষে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সদস্যভুক্ত দেশ হিসেবে আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে ১.১২ বিলিয়ন ডলার। আকু বিল পরিশোধের পর দেশের রিজার্ভ নামবে ২৯.৮১ বিলিয়ন ডলারে।

আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক গণনা পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো ৫.৫ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। তাহলে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৪.৩১ বিলিয়ন ডলারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ নয়, গ্রস রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করে, যেখানে এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণ, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রায় গঠিত তহবিলের অর্থও রিজার্ভে দেখানো হয়। এসব অর্থ বাদ দিয়ে তাত্ক্ষণিক প্রয়োজনে খরচ করার মতো যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে, সেগুলোকে নিট রিজার্ভ হিসেবে চিহ্নিত করে আইএমএফ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, রিজার্ভ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে ইডিএফের আকার সাত বিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ৫.২ বিলিয়ন ডলার করেছে। ইডিএফ থেকে নতুন করে ঋণ বিতরণও কমানো হচ্ছে। বর্তমানে এই তহবিলের আকার ৫০০ কোটি (পাঁচ বিলিয়ন) ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। সব শেষ ২০ কোটি ডলার কমানো হয়েছে।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আইএমএফ বেশ কিছুদিন ধরে ইডিএফের আকার কমাতে বলে আসছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, ইডিএফের আকার আরো ২০ কোটি ডলার কমানো হয়েছে। এই তহবিলের আউটস্ট্যান্ডিং এখন পাঁচ বিলিয়ন ডলার।

সাধারণত ঈদুল আজহার মাসে রেমিট্যান্স অনেক বেশি আসে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু চলতি ঈদে ভিন্নচিত্র দেখা গেছে।

প্রবাস আয়ে ভাটা : ঈদুল ফিতরের মাসে কমেছে রেমিট্যান্স। সদ্যঃসমাপ্ত এপ্রিল মাসে বৈধপথে বা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৬৮ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে এসেছে। এই অঙ্ক চলতি বছরের মার্চ ও আগের বছরের এপ্রিল—এ দুই সময়ের তুলনায়ই কম।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে ১৬৮ কোটি ৩৪ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা) এ অর্থের পরিমাণ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এই অঙ্ক আগের মাসের চেয়ে তিন কোটি ৩৯ লাখ ডলার কম। মার্চে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২ কোটি ২৫ লাখ ডলার। আগের বছর ঈদুল ফিতরের সময় অর্থাৎ ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০১ কোটি আট লাখ ডলার।

রপ্তানি আয় কমল টানা দুই মাস : প্রবাস আয়ের পর গত এপ্রিলে পণ্য রপ্তানিতেও ধাক্কা লেগেছে। এই মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩৯৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬.৫২ শতাংশ কম।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সব শেষ তথ্য বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি বাবদ চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আয় হয়েছে ৩৯৫ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার; যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭৮ কোটি ২৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার কম।

ব্যবসায়ীরা অবশ্য আগেই বলেছিলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি কমেছে। তাঁদের আশঙ্কা সামনের দিনে আরো কমতে পারে রপ্তানি আয়।

অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন : পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে ডলারসংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। কিন্তু আইএমএফের শর্তপূরণ করতে হলে ডলার বিক্রি বন্ধ করতে হবে। এখান থেকে বের হয়ে আসাটা সহজ হবে না। এই পরিস্থিতিতে ঋণের সুদ হার বাড়ালে কিছুটা সাপোর্ট পাওয়া যেত। কিন্তু সেটাও করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা সময়োপযোগী হচ্ছে না। সিদ্ধান্তহীনতার কারণে আমরা যথাসময়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে পারছি না। আমাদের বিড়ালের মতো পা ফেললে হবে না, ঘোড়ার মতো দৌড়াতে হবে।’

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, রিজার্ভ ব্যবহারে আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কেননা এখন রিজার্ভ বেশি থাকলে মুদ্রার মান এত বেশি হারে কমত না। আমদানি নিয়েও খুব বেশি দুশ্চিন্তা করতে হতো না। রিজার্ভকে সুরক্ষা করতেই হবে। রেমিট্যান্স-রপ্তানি বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের বরাদ্দ করা যেসব অর্থ পাইপলাইনে আটকে আছে, সেগুলো ছাড় করানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে। যাতে আমদানি কম করতে হয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় রিজার্ভ ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। আমদানিও খুব কমছে না। হুন্ডি-অর্থপাচার চলছে। এগুলো কমানো না গেলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে ফি কমানোর পাশাপাশি প্রক্রিয়া আরো সহজ করতে হবে। শুধু তৈরি পোশাকের ওপর ভর না করে রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/05/04/1276620