৪ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:০০

বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় আরো চাপ বাড়ার শঙ্কা

একসাথে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের উল্টোযাত্রা

দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসার প্রধান দু’টি খাত হলো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়। ঈদের মাস সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহের প্রধান এ দুইটি খাতই উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করেছে। গত এপ্রিলে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স দু’টিতেই সাড়ে ১৬ শতাংশ করে কমে গেছে। গতকাল রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত এপ্রিলে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি আয় কমে গেছে ১৬.৫২ শতাংশ। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এপ্রিলে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এ প্রধান দু’টি খাত হোঁচট খাওয়ায় কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে সংশ্লিষ্টদের।

ব্যাংকারদের মতে, এর ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় চাপ আরো বেড়ে যাবে। কারণ, সামনে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ ব্যয় বেড়ে যাবে। একই সাথে ব্যয় মেটানোর জন্য ডলারের পর্যাপ্ততা আরো কমে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ডলারের মূল্যের ওপর। ইতোমধ্যে আমদানিতে ডলারের মূল্য এক টাকা থেকে দেড় টাকা বেড়ে গেছে। যেখানে আমদানিতে ডলারের দাম ১০৫ টাকা থেকে ১০৬ টাকা ছিল। সেখানে গতকাল ১০৬ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ১০৭ টাকা ৯৫ পয়সায় উঠে গেছে। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকও ডলারের দাম প্রায় দেড় টাকা বাড়িয়েছে। গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছিল ১০৩ টাকা দরে। গতকাল তা বিক্রি করেছে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যাবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতির ওপর।

গতকাল ইপিবি রফতানির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, পর পর দুই মাস ধরে রফতানি আয় কমে গেছে। গত মার্চে রফতানি আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে যেখানে আড়াই শতাংশ কমেছিল, গত এপ্রিলে তা না বেড়ে বরং আরো বেশি পরিমাণ কমে গেছে। গত এপ্রিলে রফতানি আয় কমেছে ১৬.৫২ শতাংশ। শুধু রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিই কমেনি, ইপিবি প্রতি মাসে রফতানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল, বাস্তবায়ন হয়েছে তা থেকেও প্রায় ২২ শতাংশ কম। গত এপ্রিলে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৫০ কোটি টাকা, বিপরীতে অর্জন হয়েছে ৩ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা কম অর্জন হয়েছে। আবার গত বছরের এপ্রিলে রফতানি আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। সেখানে এ বছর না বেড়ে বরং ৭৮২ কোটি টাকা কমে হয়েছে ৩ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা।

ইপিবির পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, রফতানি আয় কমে যাওয়ার অন্যতম খাত হলো তৈরী পোশাক খাত। গত জুলাই-মার্চে তৈরী পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২.১৭ শতাংশ, জুলাই-এপ্রিলে তা না বেড়ে বরং কমে হয়েছে ৯.০৯ শতাংশ। হোম টেক্সটাইলের খাতেও রফতানি গত মার্চ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ঋণাত্মক ২৫.৭৩ শতাংশ, সেখানে জুলাই-এপ্রিলে এসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক প্রায় ৩০ শতাংশ। এ ছাড়াও অন্যান্য খাতেও রফতানি আয় কমে গেছে। সবমিলেই রফতানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এদিকে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত রফতানি আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি রেমিট্যান্সও কমে গেছে। সাধারণত ঈদের আগে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়ে যায়। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম হয়েছে প্রবাসী আয়ে। গত এপ্রিলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে আগের এপ্রিলের তুলনায় প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুইটি খাত রফতানি ও রেমিট্যান্স এক সাথে কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় চাপ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এমনিতেই আগে থেকেই ডলারের সঙ্কট ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে আগের মতো পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় এলসি খোলা হচ্ছে না। এর ফলে আমদানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ৫০ শতাংশ, চলতি বছরে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৩৮.১৬ শতাংশ। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে প্রকৃতপক্ষে পণ্য আমদানিতে ব্যয় কমেছে প্রায় ৮৮ শতাংশ। পণ্যের কাঁচামাল আমদানিসহ সামগ্রিক আমদানি ব্যয় কমে যাওয়ায় রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে রফতানি আয় কমে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

অপরদিকে বিশ্লেষকরা মনে করছেন টাকা পাচার ঠেকাতে না পারলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ানো মোটেও সম্ভব হবে না। তার বড় কারণ হলো, প্রতি বছর ঈদের আগে প্রবাসীরা দেশে থাকা আত্মীয় পরিজনের কাছে বেশি পরিমাণ অর্থ পাঠান। এ সুবাদে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়ে যায়। কিন্তু গত বছরের চেয়ে বিদেশে কর্মরত শ্রমিক কমেনি, কিন্তু বৈধপথে রেমিট্যান্স না বেড়ে বরং সাড়ে ১৬ শতাংশ কমে গেছে। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় রেমিট্যান্সের অর্থ কোথায় যাচ্ছে।

একসাথে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কমে যায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় চাপ আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করা করা হচ্ছে। কারণ ইতোমধ্যেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়নের ঘরে নেমে যাবে। আকুর দায় পরিশোধ করতে হবে প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এটা হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো কমে যাবে। আর আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী তা ২১ বিলিয়নের ঘরে নেমে যাবে।

বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আমদানিতে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। এর অন্যতম কারণ হলো একদিকে ডলার সরবরাহ কমে যাওয়া ও অপরদিকে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আসতে নিরুৎসাহিত করা। ইতোমধ্যে গতকাল পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে রিজার্ভ থেকে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যেভাবে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/745321