৪ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৭

রাজনীতিতে অতিমাত্রায় ‘পলিটিক্স’

-মোস্তাফিজুর রহমান

‘রাজনীতি’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ পলিটিক্স। এই পলিটিক্স শব্দটি মূলত তিনটি গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে। এগুলো হলো- পোলিস, পলিটি ও পলিসিয়া। প্রাচীন গ্রিসে রাজনীতি বলতে নগররাষ্ট্র ও তার শাসনব্যবস্থার বস্তুগত ও দর্শনগত দিকগুলোর অধ্যয়ন বোঝাত। বিদ্রƒপার্থে কেউ কেউ রাজনীতির অন্য অর্থও করেন। তারা বলেন, ন্যায়-নীতিবিবর্জিত উপায়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের অনন্য উপায় হলো রাজনীতি। দেশ-কাল স্থান ভেদে এর ব্যাপ্তিতে পরিবর্তন হতে পারে। হালে বিশ্বব্যাপী পরিশীলিত রাজনীতির দেখা পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, মানুষ এক রাজনৈতিক জীব। তার রাজনৈতিক ধারণায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য ছিল রাজনীতি। অ্যারিস্টটল বলেন, রাজনীতি হলো নগররাষ্ট্র পরিচালনা ও নাগরিক সম্পর্কিত জ্ঞান বা শৃঙ্খলা বিশেষ। তার ধারণা- সরকার, আইনসভা, বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক দল, নানা ধরনের স্বার্থগোষ্ঠী, আমলাতন্ত্র, নির্বাচন ও নির্বাচনী কাজকর্ম ইত্যাদির মধ্যে রাজনীতি বিদ্যমান। রাজনীতির পুরনো ধারণায় এটিই বিশ্বাস করা হতো যে, রাষ্ট্র ও রাজনীতি পরস্পর বিশেষভাবে সম্পর্কিত। এই ধারণা মতে, মনে করা হয় যখন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়নি তখন রাজনীতিও ছিল না। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী রাজনীতির ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এটি এখন শুধু একটি রাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন বৃহৎ জাতীয় রাষ্ট্র থেকে আন্তর্জাতিক সমাজে বিস্তৃত হয়েছে। সে কারণে রাজনীতি এখন মূলত বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিচার করা হয়। বর্তমানে মানুষের রাজনৈতিক জীবন অত্যন্ত জটিল ও সমস্যাসঙ্কুল। এই সমস্যাসঙ্কুল রাজনৈতিক জীবন-যাপনে ও রাষ্ট্রে টিকে থাকতে মানুষকে সুবিধামতো নানান কৌশলও আয়ত্ত করতে হয়। দেশ কাল-স্থান ভেদে এই রাজনৈতিক কৌশলের অপর নাম ‘পলিটিক্স’। যে সব স্থানে প্রচলিত রাজনীতি নেই সেখানেও কিন্তু এই পলিটিক্স বিরাজমান। আমরা বাঙালি হিসেবে প্রতিনিয়ত এরকম হাজারো পলিটিক্সের শিকার এবং পরিচিত। যেমন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নিজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রমাণে প্রচলিত ‘ফ্যামিলি পলিটিক্স’। গ্রাম্য সমাজে প্রচলিত ‘ভিলেজ পলিটিক্স’। কর্মজীবী মানুষের কর্মক্ষেত্রে প্রচলিত ‘অফিস পলিটিক্স’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। খ্যাতনামা অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি বলেন, এখন রাজনীতি শুধু রাজ্য বা রাষ্ট্রকাঠামোর সাথে সম্পৃক্ত নয়। সমাজের সব স্তরে তা বিরাজমান। এ ক্ষেত্রে আরেক খ্যাতনামা অধ্যাপক রবার্ট ডালের বক্তব্য উল্লেøখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, রাজনীতি হলো মানব অস্তিত্বের একটি অপরিহার্য দিক। প্রত্যেক ব্যক্তি কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত। প্রত্যেকের জীবনেই রাজনীতির প্রভাব বিদ্যমান। অর্থাৎ রাজনৈতিক স্বার্থের সাথেই মানুষের ব্যক্তিজীবন বা সামাজিক জীবন বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। রাজনীতির সর্বজনীন ধারণায় জনগণের আর্থ-সামাজিক জীবন মানের ক্রমবিকাশকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি বিভাগসমূহকে পরিপূর্ণ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আমাদের এই উপমহাদেশে রাজনীতির সংজ্ঞায় যাই থাকুক না কেন, এ অঞ্চলের রাজনীতি পরিশীলিত রুচিবোধের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দেশগুলো থেকে পৃথক। আবার উপমহাদেশের মধ্যে জনবহুল এই বাংলাদেশের রাজনীতি বেশ খানিকটা স্বতন্ত্র। লেখার শুরুতেই বলেছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতিমাত্রায় পলিটিক্স মিশ্রিত। রাজনীতিতে পলিটিক্সের মিশ্রণ অনেকটা খাদ্যে বিষ বা ফরমালিন-কার্বাইড মেশানোর মতোই।

খাদ্যে ফরমালিন যেমন মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তেমনি পরহিতকর পরিশুদ্ধ ও নির্মোহ রাজনীতিতে পলিটিক্স অহিতকর। এ দেশের রাজনীতিতে ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে বড় কিছু নেই। আর এই ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে যে যত পারঙ্গম দেখাতে সক্ষম ক্ষমতার ময়দানে তার টিকে থাকা তত সহজ। বাঙালি সমাজে পলিটিক্স ব্যাপক নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত একটি শব্দ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পলিটিক্স-মিশ্রণে প্রায় সব দলের কমবেশি হাত রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের সমতুল্য কেউ নেই। বাংলাদেশে সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি এখন প্রায় মৃত। রাজনীতির আড়ালে যা দেখছি তার সবই পলিটিক্স-মিশ্রিত দূষিত রাজনীতি। দলগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতিমাত্রায় পলিটিক্স ঢুকিয়ে দেশের স্বাভাবিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিনষ্ট করেছে। রাজনৈতিক সচেতনদের ধারণা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারপরনাই পলিটিক্স বিদ্যমান। ফলে মানুষের স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার প্রাপ্তিও নিশ্চিত হচ্ছে না। নাগরিকরা তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি এর ফলে রাষ্ট্রের অপরিহার্য অঙ্গ ও গণতন্ত্র বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনীতিবিদরা সর্বদাই তাদের ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ অটুট রাখতে সক্ষম হলেও নাগরিকরা তাদের অধিকার আদায় করতে পারছে না। সুস্থ ধারার রাজনীতির বদলে হাজারো পলিটিক্স-মিশ্রিত রাজনীতির কারণে সাধারণ মানুষ এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে শঙ্কিত ও হতাশ। এ ধরনের নোংরা পলিটিক্সের মাধ্যমে কে কাকে কিভাবে ঠকিয়ে, বেআইনি কূটকর্ম দিয়ে পরাস্ত করে, নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিতভাবে অন্যের স্বাভাবিক সুন্দর রাজনৈতিক অধিকার হরণ করতে পারবে তার প্রতিযোগিতা চলে। অথচ এগুলো কখনোই রাজনৈতিক সভ্যতা নয়। রাজনীতিরও একটি নিজস্ব সোভা আছে। আর এই শোভা তখনই ফুটে ওঠে যখন রাজনীতিবিদরা মানুষের কল্যাণে কাজ করেন। একটি সম্পূর্ণ কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে তার রাজনৈতিক জীবন ব্যয় করেন। এগুলোই রাজনীতির সৌন্দর্য। যদিও আমাদের দেশে শূন্য রাজনৈতিক জ্ঞান নিয়েও একজন আমলা বা সেনা-কর্মকর্তা সরকারি চাকরি শেষে সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিতে রাজনীতি করার অঙ্গীকার নিয়ে রাজনীতিতে আসেন। অঙ্গীকারে মানুষের কল্যাণের কথা বলা হলেও এগুলো সবই মেকি বা পলিটিক্স-মিশ্রিত রাজনৈতিক বুলি। রাজনীতিতে প্রবেশ করেই তার মূল লক্ষ্য ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করা। আর এগুলো করার পথে প্রতিপক্ষ যত প্রকার বাধাই সৃষ্টি করুক না কেন সে বাধা অতিক্রম করে যেকোনো ক্ষতিকর পন্থা গ্রহণে তারা পিছপা হন না। ফলে দেশে সুষ্ঠু স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ আর অবশিষ্ট থাকে না। শুরু হয় পারস্পরিক সঙ্ঘাত, খুনাখুনি, হামলা-মামলা ইত্যাদি। অবশ্য দলের মধ্যে কেউ কেউ নোংরা পলিটিক্স-মনস্ক ঝানু বা পটুদের বিশেষ কদর করে থাকে। দল টেকাতে, অবৈধ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে বা পরমত দমনে এদের ব্যবহার করা হয়। রাজনীতিতে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের বিনাশ করা, ভোট চুরি-ডাকাতিতে দক্ষতা, নিজেরা দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে অন্যের নামে চালিয়ে দেয়া, ভোটাধিকার হরণ করে নিজেদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা, চরম মিথ্যাকেও সত্য বলে চালিয়ে দিতে পারা এবং ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের ভাগিয়ে আনা সবই রাজনীতির বাইরে নোংরা পলিটিক্স।

২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ যা করেছে তার সবই পলিটিক্স। বিএনপি নেতাকর্মীদের হাজার হাজার মামলা দিয়ে যা করেছে তা পলিটিক্স। উকিল আব্দুস সাত্তারকে নিয়ে যা করেছে সেটিও পলিটিক্স। আবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকার যা করছে তাও পলিটিক্স। এ ধরনের অসংখ্য পলিটিক্সের সাথে আমরা পরিচিত। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এই যে দেশী-বিদেশী চাপ তা মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ ও সরকারের যে কৌশল তাও নিঃসন্দেহে পলিটিক্স। বিএনপিকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে, ধোঁকাবাজি বা চাপে ফেলে, আরো বেশি উকিল সাত্তার বানিয়ে গোঁজামিল মার্কা আরেকটি নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় আসার যে সাধ আওয়ামী লীগ দেখছে সেগুলো সবই নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত পলিটিক্স। বর্তমানের টানা ১৫ বছরসহ অতীতে আওয়ামী লীগ যতবারই ক্ষমতায় এসেছে বিএনপি ততবারই একবারে নতুন কিছু আওয়ামী পলিটিক্সের মুখোমুখি হয়েছে এবং অর্জন করেছে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। হয়তো সে কারণে বিএনপি আর কখনো আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড়। বাংলাদেশে যে সব পরিবার ভারতীয় সিরিয়াল নাটকের পারিবারিক পলিটিক্স দেখে তা আয়ত্ত করেছেন তাদের সাথে অন্য কোনো পরিবারের কোনো তুলনা হয় না। ভারতীয় সিরিয়াল দেখা ওই পরিবারগুলো নোংরা কূটকৌশলসমৃদ্ধ পরিবার। এত কিছু দেখে, শোনে, বুঝে ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি কী ধরনের পাল্টা কৌশল অবলম্বন করে তাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : কলামিস্ট
mostafizur188@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/745206