৩ মে ২০২৩, বুধবার, ৯:০২

সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর এপ্রিল দেখল ঢাকা

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সারি সারি ভাটায় ইট পোড়ানো চলছে। চুল্লি দিয়ে নির্গত হচ্ছে কালো ধোঁয়া। দূষিত হচ্ছে বাতাস। রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী আশপাশের ইটভাটা। ঢাকার কেরানীগঞ্জের জাজিরা এলাকা থেকে তোলা। ছবি : শেখ হাসান
তাপপ্রবাহের পর রাজধানীতে বায়ুদূষণেও রেকর্ড করেছে গেল এপ্রিল মাস। গত সাত বছরের এপ্রিল মাসগুলোর তুলনায় এ বছরের এপ্রিল ছিল রাজধানীবাসীর জন্য সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর। এ সময়ের গড় বায়ুদূষণের তুলনায় এবার এপ্রিলে বায়ুদূষণ বেড়েছে প্রায় ২৬.৯৩ শতাংশ। এই আটটি এপ্রিল মাসে এক দিনের জন্যও বিশুদ্ধ বাতাস পায়নি ঢাকার মানুষ।

রাজধানীর বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) আট বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এপ্রিলে বায়ুদূষণের এই চিত্র পাওয়া গেছে। বিশ্বের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার নাউয়ের পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত বায়ুমান সূচকের (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স—একিউআই) উপাত্ত সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে ক্যাপস।

বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এক যৌথ প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো ইটভাটার ধোঁয়া ও ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া এবং নির্মাণকাজ থেকে সৃষ্ট দূষণ। তবে ক্যাপস বায়ুদূষণের ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো নির্মাণকাজ, ইটভাটা ও শিল্প-কারখানা, যানবাহনের ধোঁয়া, আন্তর্দেশীয় দূষণ (নেপাল ও ভারত থেকে আসা দূষিত বাতাস), রান্নাঘরের ধোঁয়া এবং শহুরে বর্জ্য।

বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, বায়ুমান সূচক ৫০-এর নিচে থাকলে তাকে ভালো বা বিশুদ্ধ বাতাস ধরা হয়। ৫১ থেকে ১০০-এর মধ্যে থাকলে সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। সূচক ১০১ থেকে ১৫০-এর মধ্যে হলে সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল মানুষের (শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি) জন্য অস্বাস্থ্যকর ধরা হয়। ১৫১ থেকে ২০০ হলে সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং সূচক ২০১ থেকে ৩০০ হলে বাতাসকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। আর সূচক ৩০০ ছাড়ালে সেই বাতাস দুর্যোগপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ক্যাপসের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের গড় বায়ুমান সূচক ছিল ১৩৯.৭২। কিন্তু এ বছরের এপ্রিলে গড় বায়ুমান পাওয়া গেছে ১৭৭.৩৫। গত বছর এপ্রিলের গড় বায়ুমান ছিল ১৪৫। গত বছরের তুলনায় এই বছর এপ্রিলের গড় বায়ুমান ২১.৯৪ শতাংশ এবং গত সাত বছরের তুলনায় ২৬.৯৩ শতাংশ খারাপ ছিল।

অস্বাভাবিক ও অস্বাস্থ্যকর এপ্রিল : তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এপ্রিলের ৩০ দিনের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর বাতাস ছিল ১৪ দিন। সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর ছিল আট দিন। খুব অস্বাস্থ্যকর বাতাস ছিল আট দিন, যা অন্য এপ্রিলের তুলনায় এবারের এপ্রিল মাসের বড় অস্বাভাবিকতা। কারণ আগের সাত বছরে এপ্রিল মাসগুলোয় কখনোই আট দিন খুব অস্বাস্থ্যকর বাতাস লক্ষ করা যায়নি।

এর আগে ২০২১ ও ২০১৮ সালের এপ্রিলে সর্বোচ্চ দুই দিন খুব অস্বাস্থ্যকর বায়ু পাওয়া গেছে। আট বছরে সব মিলিয়ে এপ্রিলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বায়ু ছিল ১৪ দিন। এর আট দিনই ছিল গত এপ্রিল মাসে। তাই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এ বছর এপ্রিলের বায়ুমানের এই চিত্রকে অস্বাভাবিক বলছেন।

এই অস্বাভাবিকতার কারণ জানতে চাইলে ক্যাপসের চেয়ারম্যান ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরোপুরি নিশ্চিত হতে না পারলেও ইটের ভাটা, প্রচুর রাস্তা খনন, স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত বায়ুমানের এই অবস্থার জন্য দায়ী। এ বছরের এপ্রিলের অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহও বায়ুদূষণে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে পারে।

এ ছাড়া এবার এপ্রিল মাসে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডও অস্বাভাবিক বায়ুদূষণে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, রোজার সময় পর পর দু-তিনটি অগ্নিকাণ্ডে লম্বা সময় ধরে পোড়া ধোঁয়া পরিবেশে মিশেছে। পর্যাপ্ত বাতাস না থাকায় এই ধোঁয়া ও ধুলাবালি দূরে যায়নি। এ কারণে ঢাকার আকাশের নিম্নস্তরে এই ধোঁয়া ও ধুলাবালি থেকে যেতে পারে। তবে সঠিকভাবে সব কারণ বের করার জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।
তবে বায়ুদূষণের সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন না নগরবিদ ও পরিবেশকর্মী ইকবাল হাবিব। বছরের পর বছর বায়ুদূষণ রোধে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াটাকেই বড় করে দেখছেন তিনি। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, বায়ুদূষণ হঠাৎ করে বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং প্রতিবছর নির্মাণযজ্ঞ বাড়ছে। দূষণ রোধে সরকার যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি। নির্মাণ কার্যক্রম থেকে শুরু করে শুষ্ক মৌসুমে ইটের ভাটার বিশাল কর্মযজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ—কোনোটাই করা হয়নি। সরকারি প্রকল্পগুলোতে ইটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব ব্লকের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা যায়নি।

এই দূষণে সিটি করপোরেশনের বড় একটা দায় আছে বলে মনে করেন ইকবাল হাবিব। তিনি জানান, বর্জ্য থেকে মিথেন গ্যাস ও প্রচুর পরিমাণে দূষক বের হয়। অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও সিটি করপোরেশন এই দূষণ রোধে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

এর আগে ক্যাপসের আরেক গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সাত বছরের জানুয়ারি মাসের গড় বায়ুমান বিবেচনায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয়েছে। এ বছর জানুয়ারি মাসের গড় বায়ুমান ছিল ২৮১, যা খুব অস্বাস্থ্যকর। জানুয়ারিতে মোট ১০ দিন রাজধানীর বায়ু দুর্যোগপূর্ণ ছিল।

এপ্রিলে ঢাকায় ভালো বাতাস নেই : ক্যাপসের হিসাব অনুযায়ী, গত আটটি এপ্রিল ঢাকার মানুষ এক দিনও ভালো বায়ু সেবন করতে পারেনি। ক্যাপস জানায়, এবারের ঈদুল ফিতরেও ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয়েছে। এ সময় গড় বায়ুমান সূচক ১৫৩, যা অস্বাস্থ্যকর বায়ুকে নির্দেশ করে।

ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, ‘এ সময় বৃষ্টি কম হয় বলে এমনিতেই বায়ুদূষণ বেশি থাকে। তবে এ বছরের এপ্রিলের সঙ্গে গত সাত বছরের এপ্রিলের বায়ুদূষণের তুলনা করতে গিয়ে দেখছি আমাদের আগের ধারণা টিকছে না। অর্থাৎ মৌসুমের প্রবণতা হিসেবে এবার বেশি বায়ুদূষণ ছিল, এই ধারণা এখন আর কার্যকর হবে না। বরং স্বাভাবিক গড় বায়ুমানের প্রবণতার বাইরে গিয়ে এবারের এপ্রিল আগের সব এপ্রিলকে ছাড়িয়ে গেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘শিগগিরই এর কারণ অনুসন্ধানে আমাদের গবেষণা করা উচিত।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/05/03/1276319