৩ মে ২০২৩, বুধবার, ৮:৫৮

কেন শহর ছাড়ছে মানুষ?

কর্মসংস্থানের সুযোগ, স্বাস্থ্য-শিক্ষাসহ বিলাসবহুল নাগরিক জীবনে আকৃষ্ট হয়ে শহরমুখী হয় মানুষ। সেই সঙ্গে নানা দুর্যোগে গৃহহারা-নিঃস্ব মানুষরাও পাড়ি জমায় শহরে। দেশে গ্রাম থেকে শহরে আসার হার দিন দিন বাড়লেও সম্প্রতি তা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স-২০২১’- শীর্ষক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে।

করোনা পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শহরে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি না হওয়া এবং গ্রামাঞ্চলে কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি হওয়ার কারণে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে শহর থেকে গ্রামে স্থানান্তর হয়েছে হাজারে ৮ জন, যা ২০২০ সালে ছিল ৪ দশমিক ৭ জন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে স্থানান্তর বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এর আগে ২০১৭ সালে গ্রাম ছেড়ে শহরে স্থানান্তর করেছিল হাজারে ৫ জন এবং ২০১৮ সালে সেটি কমে ৪ দশমিক ৯ জনে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালে সেটি আরও কমে ৪ দশমিক ৩ জনে দাঁড়ায়। অন্যদিকে পল্লী হতে পল্লীতে স্থানান্তর প্রতি হাজারে ৩১ দশমিক ৯ জন, যা ২০২০ ছিল ৩২ দশমিক ৭ জন।

জরিপে বলা হয়েছে, শহরের মধ্যেই স্থানান্তর হয়েছে হাজারে ১২৫ দশমিক ৯ জন, যা ২০২০ সালে ছিল ১০৯ দশমিক একজন। পল্লী হতে শহরে স্থানান্তর ৩০ দশমিক ৮ জন, যা ২০২০ সালে ছিল ৩১ দশমিক ৩ জন। শহর হতে শহরে স্থানান্তর ৯৫ দশমিক ১ জন, যা ২০২০ সালে ছিল ৭৭ দশমিক ৮ জন।

বহির্গমন হার প্রতিহাজারে ৫৫ দশমিক ৯ জন, যা ২০২০ সালে ছিল ৭০ দশমিক ৩ জন।
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের শহর ছাড়া থেমে নেই। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভাগ্য বদলাতে ঢাকায় আসা সীমা বেগম এপ্রিলে দুর্ভোগ নিয়ে গ্রামে ফিরেছে। সীমা বেগম জানান, তার স্বামী কাজ করেন কাওরান বাজারের একটি আড়তে। সেখান থেকে তার মাসিক আয়, ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা। ভেবেছিলাম এই আয় দিয়েই ঢাকায় পুরো পরিবার নিয়ে থাকতে পারবো।

এজন্য আমি ও দুই সন্তান গ্রাম থেকে শহরে চলে আসি। ছেলে ও মেয়েরও ইচ্ছা ছিল বাবার সঙ্গে থাকার এবং ঢাকায় লেখা-পড়া করার। কিন্তু আমারা এই আয় দিয়ে টিকতে পারলাম না। এজন্য ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। গ্রামে চলে যাওয়ার আগে তেজকুনি পাড়ায় তিন মাস বাস করা সিমা বেগম এসব কথা জানান। তিনি বলেন, ঢাকার জন্য এই তিন মাস ছেলে সিফাত ও মেয়ে জান্নাতকে কোনো স্কুলে ভর্তি করাতে পারিনি।

তেজকুনি পাড়ায় একরুমের ভাড়া দিতে হতো ৮ হাজার টাকা। আমাদের যা আয় তা দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়া সম্ভব না। এজন্য ছেলে-মেয়েকে নিয়ে একরুমের মধ্যে গত তিন মাস থেকেছি। ওরা বড় হচ্ছে। একসাথে থাকাও সম্ভব হচ্ছে না। সবমিলিয়ে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এজন্য আমি ও সন্তানদেরকে নিয়ে আবারও গ্রামে চলে যাচ্ছি। আমার স্বামী প্রায় ২০ বছর ধরে কাওরান বাজারে কাজ করেন, এজন্য উনি ঢাকাতেই থাকবেন। গ্রামে চলে গেলে উনার পাঠানো টাকা দিয়ে কোনোভাবে সংসার চলে যায়।

শুধু সীমার পরিবারই নয়, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে হিমশিম খাওয়া অনেক মানুষ আর ঢাকায় টিকতে পারছেন না। তেমনি একজন আতোয়ার রহমান। কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সন্তান ও স্ত্রীকে গ্রামে রেখে এসেছেন তিনি। আতোয়ার জানান, গত কয়েক বছর ধরে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। সব জিনিসের দাম আওতার বাইরে চলে গেছে। কিন্তু বেতন সেভাবে বাড়েনি। এজন্য সন্তান ও স্ত্রীকে গ্রামে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, আগে সন্তান ছোট ছিল, এজন্য তার পড়াশোনার খরচ লাগতো না। এজন্য কষ্ট করে হলেও সংসার চালিয়ে নিতাম। কিন্তু এখন সন্তানের পড়ালেখার খরচ যুক্ত হয়েছে। ফলে, ঢাকায় সন্তানকে পড়িয়ে সংসার চালানো সম্ভব না। এজন্য তাদেরকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি।

শহর ছেড়ে গ্রামে স্থানান্তরের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মানবজমিনকে বলেন, করোনার কারণে অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়েছে এটি সত্য। কিন্তু মূল বিষয় হলো- শহরে চাকরি কমে গেছে। শহরে নতুন নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না। আগের চেয়ে কাজের ক্ষেত্র কমেছে। নির্মাণকাজ আগের চেয়ে কম হচ্ছে। এজন্য ব্যাপকসংখ্যক মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আরএমজি (তৈরি পোশাক) সেক্টরে অনেক মহিলা কাজ করেন।

একটা বয়সের পর তারা আর চাকরি করেন না। তখন তারা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান। এটাও হতে পরে। আহসান এইচ মনসুর বলেন, গ্রামে শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। এটা কিন্তু সুখবর না। গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়া মানে ৫ জনের কাজ ১০ জনে করা। ওখানে তো কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না। জমি তো বাড়ছে না। কাজেই এটি আমাদের জন্য ভালো খবর না।

২০২১ সালে শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার হার বেড়ে যাওয়ার দু’টি কারণ দেখছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণের ভয়ে ওই সময় অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যায়। আরেকটি কারণ হলো অর্থনৈতিক। এই সময় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যায়, এই ব্যয় যাদের পক্ষে টানা সম্ভব হয়নি তারা শহর ছেড়েছে। তিনি বলেন, এখন দেখার বিষয় আগামী বছরগুলোতে মানুষের গ্রামে যাওয়ার প্রবণতাটা বেড়েছে কি-না বা অব্যাহত আছে কি-না। পরের বছরের তথ্য পেলে বোঝা যাবে মানুষ মূল্যস্ফীতির কারণে গ্রামে পরিবার রেখে আসছে কি-না।

https://mzamin.com/news.php?news=53618