২২ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১১:৩২

হাওর জনপদে কান্না

উমর ফারুক আলহাদী, সুনামগঞ্জ থেকে ফিওে : ‘ও বন্ধু তুমি শুনতে কী পাও’ বাংলা সিনেমার এ গান শুনতে পেলেও হাওরের অর্ধকোটি মানুষের কান্না কেউ যেন শুনতে পাচ্ছে না। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা তো বটেই; ভারতের পানিতে ফসল হারানো ৭ জেলার হাওরের মানুষের দুর্দশার চিত্র মিডিয়ায়ও ঠিকমতো আসছে না। পানিতে ফসল হারিয়ে দিশেহারা হাজার হাজার কৃষক। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে হাওরে বসবাসরত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। তাদের পাশে কেউ নেই। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার বালিজুরি গ্রামের কৃষক আমিরুল ইসলাম (আমির মেম্বার) ছলোছলো চোখেই বললেন, ‘বানের পানিতে গরু-ছাগল গেলোগি; আশা করছিলা ছয় মাস মাছ ধরি সংসার চলাইতাম; কিন্তু সে আশায়ও গেলোগি। ভারতের উন্মুক্ত ইউরেনিয়াম খনি থেকে বানের পানিতে ভেসে আসায় তেজষ্ক্রিয়তা ছড়িয়েই হাওরের মাছ-ব্যাঙসহ সব কীট-পতঙ্গ মারা যাচ্ছে।’ শুধু আমির মেম্বর নয়; দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি জেলার হাওর উন্নয়ন বোর্ডের অধীনস্থ ৪৮টি উপজেলার (মোট উপজেলা ৭০) মানুষের মধ্যেই এই হাহাকার-আর্তি।

সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। কোথাও পানি নেমে যাওয়ায় পচে যাওয়া ধান গাছের গুমোট গন্ধ। মাঝে মাঝে পানিতে মাছ, হাঁস মরে পড়ে থাকার দৃশ্য। উঁচু এলাকায় দু’চারটি ধানী জমিতে ধান দেখা পাওয়া গেলেও কারো মুখে হাসি নেই। ফসল হারানোর যন্ত্রণায় সবাই যেন দিশেহারা। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা এখন আল্লাহর উপর ভরসা ছাড়া কিছুই করতে পারছেন না। যে বিস্তীর্ণ এলাকা পানি থই থই করতো; মাছ ধরার কলরব উঠতো; সেই এলাকায় সুনশান নীরবতা। চিরচেনা হাওর এখন যেন অচেনা এক বিরাণভূমি।
দেশের উত্তর-পর্বাঞ্চলের ৭ জেলার প্রায় ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬১ হেক্টর জমি হাওর এলাকায়। হাওর বোর্ডের হিসাব মতে, মোট হাওরের সংখ্যা ৩৭৩টি। সুনামগঞ্জে ৮৫, হবিগঞ্জে ১৪, নেত্রকোনায় ৫২, কিশোরগঞ্জে ৯৭, সিলেটে ১০৫, মৌলভীবাজারে ৩ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭টি হাওর রয়েছে। এই এলাকায় ৩৭৩টি হাওরের মাঝে ৪৭টি বড় হাওর রয়েছে। হঠাৎ ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে সুনামগঞ্জের ২ লাখ ৬৮ হাজার ৫৩১ হেক্টর, হবিগঞ্জের ১ লাখ ৯ হাজার ৫১৪ হেক্টর, নেত্রকোণার ৭৯ হাজার ৩৪৫ হেক্টর, কিশোরগঞ্জের ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৩ হেক্টর, মৌলভীবাজারের ৪৭ হাজার ৬০২ হেক্টর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২৯ হাজার ৬১৬ হেক্টর হাওরের জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অশ্বখুরাকৃতি-বাটির মতো নিম্নাঞ্চল।
হাওর অঞ্চল ঘুরে মনে হলো সর্বত্রই দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। জরুরীভিত্তিতে প্রয়োজনী ব্যবস্থা না নিলে হাওর জনপদের অধিবাসীরা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ এলাকার প্রায় ৩ কোটি মানুষ এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। ফসল হারিয়ে ভাটি অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের দিন কাটছে এখন অর্ধাহারে অনাহারে। নিরুপায় হয়ে অনেকেই জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছেন। সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা. তাহিরপুর, মধ্যনগর, জামালগঞ্জ, দিরাই শাল্লার মানুষেরা কাজের সন্ধানে ঢাকা চট্টগ্রাম মহানগরীর পথে। ধর্মপাশা উপজেলার বেশির ভাগ অসহায় মানুষ ঢাকার কেরানীগঞ্জ, আবদুল্লাহপুর, কামরাঙ্গীরচর, গাজিপুরে বিভিন্ন কাজের সন্ধানে আশ্রয় নিয়েছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। অনেকেই গরু-ছাগল বিক্রী করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বললে তারা জানান, জীবন বাঁচাতেই গরু-ছাগল বিক্রী করছেন। তাছাড়া ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গরুকে খাওয়ানোর জন্য খড়ও পাওয়া যাচ্ছে না। সে জন্যই অর্ধেক দামে গবাদি পশু বিক্রী করতে বাধ্য হচ্ছেন।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এবার সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট ও কিশোরগঞ্জে এক লাখ ৭১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমির ধান পানিতে ডুবে গেছে। এতে ওই তিন জেলায় ২ কোটি ৫ লাখ মণ ধান কৃষকের ঘরে উঠছে না। ফসলডুবির ঘটনায় মোট ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। নিজের ক্ষেতের ধান নষ্ট হতে দেখে অনেক কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাওর জনপদের হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান পানির নীচে, পানিতে বিষাক্ত রাসায়নিক ফলে হাওরের মাছও মরে যাচ্ছে, মরছে কামারের হাঁস, গরু ছাগল পানির দামে বিক্রি করেছেন কৃষকেরা। ঘরে নেই খাবার, আছে রোগ বালাই। অনেকেই হাওরের বিষাক্ত পানি ব্যবহার করে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ছড়িয়ে পড়ছে পেটের পীড়া ও চর্মরোগসহ পানিবাহিত নানা রোগ। হাওরের বিষাক্ত পানি ব্যবহার না করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়েছে। সুনামগঞ্জসহ ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগামী ৭ দিন হাওরে মাছ ধরতে নিষেধ করেছেন। সেই সাথে হাওরের পানি ব্যবহার না করার জন্যও বলা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হাওর এলাকার ধনী-গরিব সব মানুষের চোখেমুখে হতাশার ছাপ। শুধু গরীব কৃষকই নয়, হাওর এলাকার ধনী কৃষকেরাও এখন দিশেহারা। সর্বত্র দেখা দিয়েছে হাহাকার।
সুনামগঞ্জ জেলার প্রবাসী অধ্যুষিত জগন্নাথপুর উপজেলা। এ উপজেলার ছিলাউড়া গ্রামের বাসিন্দা আফজাল মিয়া বলেন, ফসল তো গেছেই পানির নীচে। এখন গরুর খাবারও নেই। ঘরে নেই খানি, বাড়ির চার পাশে বিষাক্ত পানি। কিভাবে বাঁচব এমনিই আছি দারুণ টেনশনে। তিনি বলেন, গরীব পরিবারের সদস্যরা শহরমুখী হচ্ছেন কাজের সন্ধানে। তারাতো কাজ করে খেতে পারবে। আবার সরকার থেকেও গরীবদের কিছু চাল দেয়া হচ্ছে। কিন্তু চরম বিপাকে পড়েছি আমাদের মতো মধ্যবিত্ত কৃষকেরা। আফজাল মিয়া বলেন, ঠিক মতো ফসল হলে বছরে প্রায় হাজার বারশ’ মণ ধান পাই। কিন্তু এবার এক মুঠো ধানও ঘরে তোলতে পারি নাই।
শাল্লা উপজেলার জাতগাঁও গ্রামের মাহাবুব আলম বললেন, পানিতে ধানের জমি তলিয়ে গেলেও সারা বছর মাছ ধরে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করত। এখন তা আর সম্ভব হচ্ছে না। কারণ পানিতে বিষাক্ত গ্যাস, আর একারণে মাছ মরে যাচ্ছে। ধান গেছে, মাছও গেছে, এখন কিভাবে বাঁচব এ চিন্তায় ঘুম হারাম।
একই উপজেলার সরসপুরের অধিবাসী মানিক মিয়া বলেন, আগে বন্যা অইলে এক আওর (হাওর) দুই আওর নিত। বাকি আওরের ধান থাকত। কাছামাছা কাইট্যা (কেটে) তুলা যাইত। ফসল গেলেগিও পানি আর মাছের কুনু সমস্যা অইত না। ইবার কাচা ধানত নিলইগা, এখন সব মাছও মরি যাইতেছে। পানিও নষ্ট অইছে। শইল্যে (শরীরে) লাগলে খালি চুলকায়। ৬৭ বছরের জীবনে ইলা অবস্থা দেখি নাই, আমার বাপ দাদাও দেখে নাই।’ তার মতো প্রবীণ কৃষকরাও উপর্যুপরি এমন দুর্যোগ দেখেননি। একটি বিপদ চলে গেলে আরেকটি দিয়ে কৃষক কোনো মতে সংগ্রাম করে জীবন কাটিয়ে দিতে পারত। এখন মাছ ও পানি নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কৃষকরা। ধানের পর এই দুটিই ছিল শেষ ভরসা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১২০ বছরের ইতিহাসে এমন চরম সংকট মোকাবেলা করতে হয়নি হাওরবাসীকে।

ধর্মপাশা উপজেলার গুল্লা রাজাপুরের বাসিন্দা ইউনুছ আলী বলেন, ‘সর্বনাশা’ অকাল বানের পানি কৃষক, খামরি-মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা তছনছ করে দিয়েছে। নবান্নের ভরা মৌসুমে কৃষক, চাষী, খামারিদের ঘরে উৎসব, আনন্দের পরিবর্তে নেমেছে বিষাদের ছায়া। ঘরে ঘরে চলছে হাহাকার, মাতম। যেন নিরব দুর্ভিক্ষ (চৈত্রের নিদান) শুরু হয়েছে হাওর জনপদে। এমতাবস্থায় কিভাবে সারাবছর সংসার আর সন্তানদের লেখা-পড়া চলবে-সে চিন্তায় উদ্বিগ্ন সবাই।
এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না পারলে সামনে হাওরাঞ্চল মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের উত্তর-পূর্ব জনপদে। যদিও জেলা প্রশাসন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী পৌছানো হচ্ছে। কম মূল্যে বিক্রি হচ্ছে ওএমএস-এর চাল ও আটা। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল বলে জানিয়েছে রাজাপুরের কৃষক মাজাহারুল মিয়া।

জামালগঞ্জ উপজেলার বেহলী ইউনিয়নের সমাজ সেবক মো: শওকত মিয়া জানান, বেহলী ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষের জমি ছিল হালির হাওরে। এবার হালির হাওর তলিয়ে যাওয়ায় ইউনিয়নের কৃষকরা ফসল হারিয়েছে। তাদের ঘরে নেই খাবার। হাতে নেই টাকা। হয়ে পড়েছে অসহায়। বেঁেচ থাকার জন্য ফসলহারা মানুষ কাজও পাচ্ছে না। কাজ দেওয়ার মত এলাকায় কোন লোকও নাই। সবাই ক্ষতিগ্রস্ত, কে কাকে কাজ দিবে। সবাই অভাব অনটনের মধ্যে পড়েছে। তিনি আরো জানান, ইউনিয়নের আহসানপুর, উলুখানি, হরিনাকান্দি, যতিন্দ্রপুর আলীপুর, মামদপুর, বদনাকান্দি ৪ গ্রাম, বদরপুর,রাজাপুর,রহিমাপুর সহ এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামের ফসলহারা অভাবী কৃষকরা কাজের সন্ধানে বাড়ী ছেড়ে ঢাকা গাজীপুর এলাকায় গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীতে এবং সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারীতে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে। তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের ১০ টাকা ও ১৫ টাকা কেজির চাল এ এলাকার সবাই পাচ্ছে না। যারা পাচ্ছেন তাদেরকেও মাঝে মধ্যে দেয়া হচ্ছে। এ চালের সরবরাহ একেবারেই অপর্যাপ্ত। ত্রাণ সাহায্য নাই বললেই চলে।
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার একমাত্র শনির হাওরটি ধান এখন পানির নীচে। কিছু এলাকা এখনও কোন উপায়ে টিকে আছে। এ হাওরেও পানিবদ্ধতায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে এ হাওর রক্ষা বাঁধে ফাটল দেখা দেওয়ায় জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম গত শুক্রবার প্রচুর বস্তা নিয়ে হাওর রক্ষা বাঁধে ছুটে যান। সারা দিন বাঁধে কাজ হয়েছে বলে জানা গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাওরাঞ্চলের গরীব কৃষকরা ফসল হারিয়ে অভাবের তাড়নায় কাজের সন্ধানে বাড়ী ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে পাড়ি দিচ্ছে, এ বিয়য়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, এটি আমার জানা নেই। পর্যাপ্ত চাল সরবরাহ করা হচ্ছে। খোলা বাজারে ১৫ টাকা এবং সরকারের ১০ টাকা কেজির চাল সরবরাহ চলছে। খাবার সরবরাহে কোন সংকট নেই। ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ হয়েছে তারা বলেছেন পর্যাপ্ত চাল বাজারে সরবরাহ আছে ।
সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক দোয়ারা বাজারের সাবেক এমপি এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন ইনকিলাবকে বলেছেন, সুনামগঞ্জ জেলাকে জরুরীভিত্তিতে দুর্গত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করার প্রয়োজন। তা না হলে আরো ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এলাকার মানুষ। কলিম উদ্দিন মিলন বলেন, ভাটি বাংলার অধিবাসীদের সারা বছর চলতে হয় এক মওসুমের বোরো ধান দিয়ে। আর এর সঙ্গে বিকল্প জীবিকা হলো মাছ ধরা। এখানকার উৎপাদিত ধান এবং মাছ দেশের চাহিদার বড় একটি অংশ যোগান দেয়। কিন্তু এবার ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ বোরো ধান তলিয়ে গেছে।

কলিম উদ্দিন বলেন, কৃষকের গোলায় ফসল উঠেনি। এরপর বিপর্যয় নামছে মৎস্য সেক্টরে। হাওরের পানিতে বিষক্রিয়ায় ভেসে উঠছে মরা মাছ। আর বিষাক্রান্ত মাছ খেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মারা যাচ্ছে খামারের হাঁস। কৃষকেরা নিরুপায় হয়ে তাদের গরু ছাগল বিক্রি করছে। আছে দেনা, অনেকে দেনার দায়ে দিশেহারা। ফসলহানির পর কয়েকদিন ধরেই হাওরে মাছ আর হাঁস মরছে। মরা মাছ, হাঁসের পচা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে। পানির পর বিষাক্ত হচ্ছে বাতাসও। খাদ্যের পর পরিবেশ বিপর্যয়ও দেখা দিয়েছে। যা থেকে নানা রোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে হাওর জনপদে।
এদিকে খাদ্য এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পানি দূষণমুক্ত করতে নানা ধরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে হাওরের পানিতে দু’দিন ধরে ঢালা হচ্ছে চুন। সেই সঙ্গে হাওর জনপদে মাইকিং করে বিষাক্রান্ত মাছ না খাওয়ার এবং হাওরে হাঁস না ছাড়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে এরই মধ্যে অনেকেই গবাদি পশু বিক্রি করতে শুরু করেছে। হাওর এলকার ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে এরইমধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ ও কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তাদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাদ্যসহ নানা ধরনের সহায়তার কথা বলা হয়েছে। আর দুর্নীতি দমন কমিশন হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে।
এদিকে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশ্মির রেজা বলেন, সবার আগে প্রয়োজন এখন হাওরের মানুষকে রক্ষা করা। তারা নিজেরা কোনোভাবেই এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে না। আমি এখানে মানবিক বিপর্যয়, এমনকি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছি।

জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, মাছ খেয়ে সহস্রাধিক হাঁস মারা যাওয়ার স্যাম্পুল সংগ্রহ করে আমরা ঢাকায় পাঠিয়েছি। এসব হাঁস ডার্ক প্লেগ রোগে মারা যায়নি। হাওরপাড়ের লোকজনকে এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
অধিদপ্তর সিলেটের বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. ইসলাম ফারুক বলেছেন, বাতাসে ধান পচার দুর্গন্ধের জন্য সমস্যা হওয়ার কথা না! তবে পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। এই পানিতে যেনো কেউ গোসল, খাবার পানি ও রান্নার কাজে ব্যবহার না করেন। দুর্গন্ধযুক্ত এই পানি ব্যবহার করলে মানব দেহে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিতে পারে। পরীক্ষার পর বলা যাবে- পানিতে কি পরিমাণ বিষক্রিয়া। এই পানির মাছ না খাওয়ারও জন্যও পরামর্শ দেন তিনি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. জহির বিন আলম বলেন, ‘সাধারণত আগাম বন্যা আসে এপ্রিলে। এবছর মার্চে চলে এসেছে, এ সময়টাতে ফসলে কীটনাশক ছিটানো হয়। আগাম বন্যা আসায় সেই কীটনাশক পানিতে মিশে গেছে। যে কারণে অ্যামুনিয়া গ্যাসের প্রভাবে পানিতে অক্সিজেন কমে বিষক্রিয়ায় মাছ মরছে। মাছ খেয়ে হাঁস ও পাখি মরছে। এখন অধিক বৃষ্টি হলে পানি বাড়বে, গ্যাসের প্রভাব কমবে। নতুবা পানিতে প্রচুর পরিমানে বিøচিং দিয়ে বাতাস মেলাতে হবে। অন্যথায় হাওরাঞ্চলে আমাদের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষের মাঝেও এর প্রভাব পড়বে।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো বায়োলজি অ্যান্ড ইমোনোলজি অনুষদের প্রধান ড. মাহবুব ই ইলাহী বলেন, অ্যামোনিয়া গ্যাসের প্রভাবে মাছ মারা যাচ্ছে। পানি ও বাতাস দূষণ হয়েছে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে হাওরাঞ্চলের মৎস্য-পশু সম্পদ তথা জীববৈচিত্র্য চরম হুমকীর মুখে পড়বে। প্রজনন মৌসুমে মাছ বিষাক্রান্ত হওয়ায় মাছের ঘাটতি দেখা দেবে। মাছ প্রজনন ক্ষমতা হারাবে।

এছাড়া বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মাছ বেশি খেলে মানবদেহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, মানুষ মারাও যেতে পারে।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিস ও হাওরের প্রত্যক্ষদর্শী কৃষকরা জানান, গত শনিবার থেকে হঠাৎ হাওরে-নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ মরে ভেসে উঠছে। বিশেষ করে গভীর পানির সুস্বাদু মাছগুলো আধমরা হয়ে নিচ থেকে উঠে হাওরে-নদীতে ভাসতে থাকে। বোয়াল, কাতলা, রিটা, রুই, বাইনসহ সুস্বাদু দেশি মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে ভাসতে দেখে উৎসুক জনতা তা ধরতে বের হন। তবে মৎস্য বিভাগ মাইকিং করে এই মাছ না খাওয়ার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে।
এদিকে হাওরের মাছ মরে যাওয়ার পর গত সোমবার ধর্মপাশার বিভিন্ন হাওরে পানি ও মাছ পরীক্ষা করেছে মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র। গবেষকরা মাছের মৃত্যুর কারণ হিসেবে পানিতে মাত্রাতিরিক্ত এমোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতি ও অক্সিজেন অস্বাভাবিক কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
জেলা মৎস্য অফিসার শঙ্কর রঞ্জন দাস ইনকিলাবকে বলেন, পানিদূষণ রোধ করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মাছের মড়ক ঠেকাতে আমরা চুন ও জিওলাইট ব্যবহার করছি। এতে মাছও রক্ষা পাবে। পানিদূষণও রোধ হবে।
সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আশুতোশ দাস বলেন, হাওরে ধান পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাতাসে দুর্গন্ধের কারণে শ্বাসকষ্ট, পেটের পীড়াসহ নানা রোগবালাই দেখা দিতে পারে, জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়তে পারে। পচা দূষিত পানি শরীরে লাগলে নানা চর্ম রোগ দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সারা জেলায় ইউনিয়ন পর্যায়ে মেডিকেল টিম গঠন করে রাখা হয়েছে।

ধর্মপাশা উপজেলার নিজামপুর গ্রামের কবীর মাস্টার বলেন, সুনামগঞ্জের সবচেয়ে নিচু উপজেলা ধর্মপাশা। প্রতি বছরের মতো এবারো মার্চের শেষ সপ্তাহে অকাল বন্যায় ডুবে গেছে এখানকার ফসল ও বাড়ির আঙ্গিনা। এ অবস্থায় গবাদিপশু রাখার মতো কোনো জায়গা পাচ্ছেন না উপজেলার কৃষকরা। পুরো উপজেলায় গবাদিপশু বিচরণের মতো কোনো তৃণভূমি অবশিষ্ট নেই। ফলে পশুকে খাওয়ানোর জন্য মিলছে না কোনো ঘাস।
জামালগঞ্জ উপজেলা সদরের বাসিন্দা সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য ব্যবসায়ী হারুন মিয়া জানান, শুধু ধর্মপাশাই নয়, জেলার জামালগঞ্জ,তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, দোয়ারাবাজার, বিশ^ম্ভরপুর, জগন্নাথপুর ও ছাতক উপজেলারও অবস্থা একই। সর্বত্রই তৃণভূমিসহ গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে উপায় না দেখে কম দামেই গবাদিপশু বিক্রি করে দিচ্ছেন এসব অঞ্চলের গৃহস্থ ও কৃষকরা।

জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জাহেদুল হক বলেন, পুরো জেলায়ই গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকে আবার অভাবের তাড়নায়ও গবাদিপশু বিক্রি করছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা জানিয়েছে, সুনামগঞ্জের ৮২ ভাগ বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ৩ লাখ কৃষক পরিবার ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গত ৩১ মার্চ থেকে ইতোমধ্যে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৬৬০ মে. টন চাল, ২৬ লাখ টাকা ও ১৫০ বান্ডিল ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে। আরো ১০ মে. টন চাল, আড়াই লাখ টাকা ও ৩০ বান্ডিল ঢেউটিন মওজুদ রয়েছে। প্রয়োজনে এসব ত্রাণ সহায়তার পরও প্রয়োজন হলে আরো বিতরণ করা হবে।
জগন্নাথপুর উপজেলার সকল নদী ও হাওরের পানি দূষিত হয়ে মাছে মড়ক দেখা দেয়ার পর এবার হাঁসে মড়ক দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে খামারিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

জানাগেছে, জগন্নাথপুরে এবার বোরো ফসলহানির ঘটনা ঘটেছে। গত প্রায় তিন সপ্তাহ আগে অকাল বন্যায় জগন্নাথপুর উপজেলার সকল হাওরের বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে যায়। গত বছর পাকা ধান তলিয়ে গেলেও এবার কাচা থোড় ধান তলিয়ে যায়। এসব ধান পানির নিচে পচে গিয়ে পানিকে দূষিত করে দেয়। গত কয়েক দিন আগে উপজেলার সকল নদী ও হাওরের পানি দূষিত হয়ে মাছে মড়ক দেখা দেয়। যদিও মাছের মড়ক রোধে জগন্নাথপুর উপজেলা প্রশাসন পানিতে ওষুধ প্রয়োগ করে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। তবে মাছের পর এবার হাঁসে মড়ক দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, নদী ও হাওরের দূষিত পানি খেয়ে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাঁসে মড়ক দেখা দেয়।

https://www.dailyinqilab.com/article/76086