৩০ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১২:০২

অস্ত্রোপচার কক্ষের তালা খুলবে কবে

হৃদযন্ত্রের জটিলতা নিয়ে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে ঢাকায় ছুটে আসেন ৩৪ পেরোনো লাকী আখতার। চিকিৎসক বলেছেন, দ্রুত করতে হবে তাঁর হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচার। কিন্তু কীভাবে! ১২ দিন ধরে অস্ত্রোপচার কক্ষে (ওটি) ঝুলছে তালা। টাকার সংকটে বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভাবনাতেই আনতে পারছেন না তিনি। তাই প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা নিয়ে দিনে দু’বার ঘুরে যান অস্ত্রোপচার ঘরের সামনে থেকে বন্ধ দুয়ার খোলা দেখার আশায়। তবে প্রতিদিন ফেরেন নিরাশ হয়ে। নিরুপায় লাকী এখন প্রতিনিয়ত জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধে আছেন।

গোপালগঞ্জ থেকে একই সমস্যা নিয়ে এ হাসপাতালে ছুটে আসেন মুরাদ হোসেন। শারীরিক অবস্থা জটিল হওয়ায় তাঁকে চার দিন ধরে রাখা হয়েছে হাসপাতালটির করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ)। সেই ইউনিটের সব কটি এসি বিকল দুই মাস। বৈদ্যুতিক পাখার যে বাতাস তা মুরাদের শরীর পর্যন্ত পৌঁছে না। বদ্ধ কক্ষে তাঁর দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা।

নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বিকল হওয়ায় টানা ১২ দিন অস্ত্রোপচার কক্ষ বন্ধের ঘটনা খোদ রাজধানীতেই, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। শুধু আইসিইউ নয়, সিসিইউ কক্ষের এসিও চলে না। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা একাধিকবার হাসপাতালটির পরিচালকের কাছে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়েও লাভ হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং এসির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের (পিডব্লিউডি) মাঝে সমন্বয়ের অভাবে চলমান অচলাবস্থা আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে থাকে। এদের ৮০ শতাংশেরই লাগে সিসিইউ সুবিধা। রোগীর শরীরে যাতে ঘাম না আসে, এ জন্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়। এখন তীব্র গরমে অনেকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। তবে এসি বিকল থাকায় রোগীদের পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে।

হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের আইসিইউ ইউনিটের এসি দিয়ে পানি পড়ে অনেক অস্ত্রোপচার হওয়া রোগীর সংক্রমণ বাড়তে থাকে। গত ১৮ এপ্রিল এক রোগীর সংক্রমণ বাড়লে তাঁকে দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। এর পর তালা পড়ে ২৯ শয্যার আইসিইউ ইউনিটে। সব শেষ এ ইউনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত মরিয়ম বেগমের অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল।
রোগীরা বেকায়দায়

জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে এ হাসপাতালে এসে বেকায়দায় পড়েছেন অনেক রোগী। শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়ে অনেকেই মারা যাচ্ছেন। ভুক্তভোগী বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের। ফলে সরকারি বিশেষায়িত এ হাসপাতালে ছেড়ে তাঁরা বেসরকারি ক্লিনিকেও যেতে পারছেন না। যাঁরা হাসপাতাল ছাড়ছেন, তাঁদের চিকিৎসা খরচ বাড়ছে প্রায় তিন-চার গুণ। চিকিৎসা খরচ যাঁদের সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন বাড়ি।

হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, আগে নানা কৌশলে দালালরা রোগী ভাগিয়ে নিত, আর এখন চিকিৎসকের পরামর্শেই তাঁরা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি রোগী যাচ্ছেন আসাদগেটের ইউরো-বাংলা ও আল-হেলাল এবং গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ হাসপাতালে।

মৃত্যু বাড়ছে
সিসিইউ ইউনিটে শয্যা রয়েছে ৪০টি। এখানে গড়ে ৭০ রোগী ভর্তি থাকেন। রোগীর পরিসংখ্যান বলছে, এই ইউনিটে তিন মাস আগে দৈনিক গড়ে ১০ থেকে ১২ রোগীর মৃত্যু হলেও এ সংখ্যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ থেকে ২০ জনে। গত শুক্রবার নতুন-পুরোনো মিলিয়ে মোট ৬৫ রোগী ভর্তি ছিলেন, এর মধ্যে মারা গেছেন ১৫ জন। সিসিইউর দায়িত্বে থাকা এক নার্স বলেন, এখন প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। দুই মাস ধরে এসি বিকল– এ তথ্য একাধিকবার পরিচালককে জানানো হয়েছে। পরিচালক জানিয়েছেন, সিসিইউ এখান থেকে সরিয়ে অন্য স্থানে নেওয়া হবে। নতুন করে এসি মেরামতে টাকা খরচ করা হবে না। নতুন সিসিইউ প্রস্তুত হতে আরও কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে জানান নার্স।

হাসপাতালে গাদাগাদি
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালটির ৪১৪ শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকেন প্রায় ১ হাজার ১০০। অতিরিক্ত রোগীর কারণে সঠিক চিকিৎসা দিতে বেগ পাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদিকে ওয়ার্ডের ভেতরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বারান্দা এমনকি হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয়ে ঢোকার মূল প্রবেশপথ পর্যন্ত মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে রোগী। হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ)। দুই মাস এসি নষ্ট। বিকল্প হিসেবে এখানে বৈদ্যুতিক পাখা থাকলেও সেগুলোও পুরোনো হওয়ায় গতি কম। এমনিতেই শয্যার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি রোগী প্রতিদিনই ভর্তি থাকছেন। এর সঙ্গে যোগ হয় রোগীর স্বজন।

গত শুক্রবার রাতে গিয়ে দেখা যায়, সিসিইউ ইউনিট সব সময় সুনসান থাকার কথা থাকলেও রোগীর ভিড়ে বেশ সরগরম। শয্যা না পেয়ে অনেক রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গরমে অতিষ্ঠ রোগী ও স্বজনরা। স্বজনরা হাতপাখা নিয়ে রোগীকে বাতাস করছেন। গাজীপুর থেকে থেকে আসা রোগী নাহিনা খাতুনের (৪৫) পাশে তাঁর পুত্রবধূ হাতপাখায় বাতাস করছিলেন। পুত্রবধূ বলেন, ‘ফ্যানের যে বাতাস, হ্যা গায় লাগে না। দ্যাহেন না ঘোরে কত আস্তে আস্তে। হেইতে বাইরে গোনে পাহা (পাখা) কিন্নি আনছি।’

২০১৮ সালেও হয়েছিল বিকল
দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্সরা জানান, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ২০১৮ সালেও একবার এসি বিকলের ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় সব ধরনের অস্ত্রোপচার দুই মাস বন্ধ ছিল। গঠন করা হয়েছিল তদন্ত কমিটি। তারা যথাযথভাবে ওটি জীবাণুমুক্ত করতে ২৬টি সুপারিশ করে। তবে এসব সুপারিশ পাঁচ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি।
কারা কী বলছেন

হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মনজুরুল আলম সমকালকে বলেন, ‘এসি বিকল হওয়ায় আইসিইউতে তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করা যাচ্ছে না। তাই ১৮ এপ্রিল থেকে আমাদের অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখতে হয়েছে। মঙ্গলবারের মধ্যে আইসিইউ ইউনিট রোগী রাখার জন্য প্রস্তুত হবে।’

আইসিইউ কর্মীরা জানান, এ মাসের শুরুতে এসি সিস্টেমের সমস্যা চিহ্নিত করে তা হাসপাতালের পরিচালককে জানিয়েছিলেন তাঁরা। পরিচালক তখন গণপূর্ত অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানান। তবে তারা দেরিতে কাজ শুরু করায় রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।

হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মীর জামাল উদ্দিন অস্ত্রোপচার বন্ধের পেছনে তিনটি কারণ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো– এসি সিস্টেম বিকল হওয়া, ঈদের ছুটিতে নিয়মিত জীবাণুমুক্তকরণ কাজে সমস্যা এবং গণপূর্তের বাড়তি সময় চাওয়া। তিনি বলেন, চিকিৎসকরা রোগীদের অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন– এটি মিথ্যা কথা। সিসিইউ ইউনিট সরিয়ে নেওয়া হবে। সেখানের বিকল এসি মেরামত করা হবে না।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সমীরণ মিস্ত্রী বলেন, শুক্রবার থেকে এটি মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। আগামীকাল (আজ রোববার) এ কাজ শেষ হবে। তবে জীবাণুমুক্ত করতে আরও ৭২ ঘণ্টা সময় লাগবে।

 

 

https://samakal.com/bangladesh/article/2304170040