৩০ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১২:০১

কাজ না পেয়ে দুর্ভোগে প্রবাসী কর্মীরা

ভালো আয়-রোজগারের আশায় মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করে অনেকে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত কাজ জুটছে না, বরং থাকা-খাওয়ার সমস্যাসহ নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যমের তথ্য ও ভুক্তভোগী প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এমন ঘটনার কথা জানা গেছে।

এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের ভাষ্য, শুধু ৫ শতাংশ নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে পরিদর্শন করতে পারে। বাকি সব নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা হয় মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের ভিত্তিতে।
মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে চুক্তির অধীনে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে সে দেশে কর্মী পাঠানো শুরু করেছে বাংলাদেশ। তিন লাখ ৫৮ হাজার ৮৯২ জন কর্মী পাঠানোর অনুমোদন রয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৩৪ হাজার ৫৯৫ জন কর্মী পাঠানো হয়েছে।
দুর্ভোগের শিকার শ্রমিকদের ভাষ্য : মালয়েশিয়ায় গিয়ে আশাহত শ্রমিকদের কয়েকজন মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে তাঁদের নানা দুর্ভোগের কথা জানান। তাঁদের পাঠানো ভিডিও ফুটেজ ও ছবিতেও এই দুর্দশার চিত্র রয়েছে। মালয়েশিয়া গিয়ে প্রত্যাশিত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিতদের মধ্যে রয়েছেন গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজের মাধ্যমে গত ১৮ ডিসেম্বর যাওয়া ৪৭ জন, গত ২৯ ডিসেম্বর যাওয়া ৪৭ জন, ফ্লামেনকো ওভারসিজের মাধ্যমে গত ৭, ৮ ও ৯ জানুয়ারি এবং ৭, ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি যাওয়া ১১০ জন।
এই প্রবাসী কর্মীরা জানান, তিন-চার মাস ধরে তাঁরা মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। তাঁরা কেউ চার লাখ ৩০ হাজার, চার লাখ ৫০ হাজার, এমনকি পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ওই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে দিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কারো চাকরি এখনো হয়নি, কারো চাকরি হলেও মিলছে না যথাযথ বেতন, কাউকে আবার চাকরি দিয়েও এক মাস পর বিনা বেতনে বের করে দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও ভিসার কাগজপত্র নিয়ে গেছেন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। এতে তাঁরা বাইরেও যেতে পারছেন না। কম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করলে কেউ আশ্বাস দেয়, কেউ ফোন ধরে না।

গত ২৯ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া যাওয়া ৪৭ জনের অন্যতম শাখাওয়াত হোসেন (ছদ্মনাম) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আসার পর আমাদের প্রথমে কুয়ালালামপুরের এক বাসায় রাখা হয়। তখন আমরা দুই বেলা করে খাবার পেতাম। চাকরির কথা বললে আমাদের ধৈর্য ধরতে বলা হয়। ২২ দিন পর সেখান থেকে আমাদের পেনাংয়ের এক বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসে দেড় হাজার রিঙ্গিত (বাংলাদেশি টাকায় ৩৫ হাজার ৮৬৫ টাকা) দিয়ে বলে যায়, এ দিয়েই চলতে হবে। আর কোনো টাকা-পয়সা দেওয়া হবে না। চাকরির কথা জানতে চেয়ে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। আমরা কী করব, কার সঙ্গে যোগাযোগ করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। দুই-চারজন করে বাইরে গিয়ে আমরা খাবার এনে দিন পার করতাম।’
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে আমাদের নিয়ে মালয়েশিয়ার কয়েকটি সংবাদপত্রে খবরও প্রকাশিত হয়। এরপর গত ১৮ এপ্রিল আমাদের বাকি ৩৬ জনকে কুয়ালালামপুরের আরেকটি বাসায় নিয়ে এসেছেন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এখানে এক বেলা করে খাবার দেওয়া হচ্ছে। গত ২৫ এপ্রিল আমাদের থেকে ৩০ জনকে কাজ দেওয়া হয়। তবে বেতন দেয়নি।’

প্রবাসীদের আরেকটি দলের সবুজ মিয়া (ছদ্মনাম) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চাকরি নিশ্চিত হওয়ার আগে কম্পানির খরচে কুয়ালালামপুরের একটি বাসায় আমাদের রাখা হয়। সেখানে কখনো এক বেলা, কখনো দুই বেলা খাবার দেওয়া হতো। গত মার্চে আমাদের এয়ারপোর্টে প্যাকিংয়ের কাজ দেওয়া হয়। তখন কম্পানি থেকে জানুয়ারিতে আসা কর্মীদের ৩০০ রিঙ্গিত আর ফেব্রুয়ারিতে আসা কর্মীদের ১৫০ রিঙ্গিত দেওয়া হয়। এ সময় কুয়ালালামপুরের পাশে নিলাই শহরের একটি বাসায় আমাদের স্থানান্তর করা হয়। আমাদের পাসপোর্ট ও ভিসা নিয়ে নেন তাঁরা। ৫ এপ্রিল বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সময় পেছানো হয়। ১৪ এপ্রিল আমাদের জন্য বাস না আসায় ভাবলাম হয়তো আজ ছুটি। কিন্তু পরের দুই দিনও এভাবে কেটে গেল। তখন আমরা কম্পানিতে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাঁরা ফোন ধরেননি। এ ব্যাপারে সহযোগিতার আশায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করেও কোনো উত্তর পাইনি।’

মাত্র ৫ শতাংশ নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যাচাই করা হয় : মালয়েশিয়ায় গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি না পাওয়া, পাসপোর্ট-ভিসা জব্দ করা এবং অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটানোসহ বাংলাদেশি প্রবাসীদের দুর্ভোগ নিয়ে মালয়েশিয়ার কিছু সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ এপ্রিল বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কোনো দেশের হাইকমিশনের পক্ষেই শতভাগ যাচাই-বাছাই করে কর্মী নিয়োগের চাহিদা সত্যায়ন করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে হাইকমিশনকে আবশ্যিকভাবে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশ হাইকমিশন ৫ শতাংশ চাহিদার বিপরীতে নিয়োগকর্তার অফিস বা প্রজেক্ট সাইট ইত্যাদি ভিজিট করে সত্যায়ন করে থাকে। বাকি ৯৫ শতাংশ মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সঠিক আছে কি না, সেসংক্রান্ত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে চাহিদাপত্র সত্যায়ন করে থাকে। হাজার হাজার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে ভিজিট করা হাইকমিশনের পক্ষে বাস্তবিকভাবেই অসম্ভব। এটি মালয়েশিয়ার শ্রমিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষেই একমাত্র সম্ভব। তাই মালয়েশিয়ার শ্রমিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্রের ওপর আস্থা রেখে শ্রমিক পাঠানোর কাজ করে থাকে হাইকমিশন।

ভুক্তভোগী প্রবাসীরা বলছেন, সাহায্যের জন্য তাঁরা হাইকমিশনে যোগাযোগ করে সেখান থেকে কোনো সদুত্তর বা সাড়া পাননি। বেশির ভাগ সময় যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না বলে জানান তাঁরা। কারণ রিং হয় কিন্তু ফোন ধরে না কেউ।

এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের বক্তব্য জানতে ই-মেইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর ভাষ্য : মালয়েশিয়ায় গিয়ে কর্মীরা চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পেলে সেই দায় বাংলাদেশের নয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ। সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ভবনের বিজয় একাত্তর হলে এক মতবিনিময়সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন।

এ সময় মন্ত্রী বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় গিয়ে তাঁরা অভিযোগ করেন চাকরি হয় না। কিন্তু তাঁদের চাকরি দেওয়ার দায় বাংলাদেশের না। এ দায় মালয়েশিয়ার। আমাদের এখান থেকে সব ঠিক করে আমরা পাঠাই। মালয়েশিয়ার কম্পানি যদি তাঁদের গ্রহণ না করে, তার জন্য আমাদের কিংবা রিক্রুটিং এজেন্টকে দোষ দেওয়া যায় না। এখানে বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি, বাংলাদেশ হাইকমিশন বা মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই।’

তিনি বলেন, ‘চাকরিসহ যাঁরা বিভিন্ন ভোগান্তির শিকার হন, তাঁরা প্রথমে বাংলাদেশ হাইকমিশনে অভিযোগ করবেন। তা না করে তাঁরা এখানে এসে অভিযোগ করেন। এটা ঠিক নয়।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/04/30/1275549