৩০ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:৫০

পাহাড়ে থামছে না আধিপত্যের লড়াই

আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পার্বত্য অঞ্চল। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় থংচুল বম (৭৪) নামের এক পাড়াপ্রধানের গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরআগে বান্দরবানের রুমা উপজেলার মুয়ালপি পাড়ায় গত মঙ্গলবার ভোর থেকে গোলাগুলীর ঘটনায় উত্তেজনা আরও বেড়েছে। সবুজ পাহাড়ে নতুন করে আবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। মোয়ালপি পাড়া থেকে আতঙ্কের মধ্যে ৪৯টি মারমা পরিবার বাড়ি ছেড়ে আসার পাঁচদিনের মাথায় এই গোলাগুলীর ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে পাড়া জনশূন্য হয়ে পড়ে। আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন পাহাড়ের বাসিন্দারা।

অস্থিতিশীল পাহাড়কে শান্ত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে আঞ্চলিক সংগঠন জন সংহতি সমিতির (জেএসএস) সাথে শান্তিচুক্তি করা হলেও কাজ হয়নি। এরপর কিছুদিন পাহাড়ে শান্তি বজায় থাকলেও গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দে¦র জেরে পার্বত্যাঞ্চলে একের পর এক উত্থান হয়েছে নতুন নতুন আঞ্চলিক দলের। গত এক দশকে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে জেএসএস (সংস্কারপন্থি), ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ (সংস্কারপন্থি), মগ লিবারেশন পার্টি ও কুকিচীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক সংগঠনের। এসব সংগঠনের সদস্যরা আধিপত্য বিস্তারে জড়িয়ে পড়ছে গুম, খুন ও চাঁদাবাজিসহ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে। শুধু তাই নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হতেও পিছপা হচ্ছে না তারা। এরআগে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন কেএনএফ-এর হামলায় প্রাণ হারান সেনাবাহিনীর এক সদস্য। এর ফলে আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাহাড়ের পরিবেশ। এর প্রভাব পড়ে পাহাড়ে বসবাসকারী বাসিন্দাদের ওপর। প্রতিদিন ভয়, উৎকণ্ঠা আর শঙ্কায় রাত কাটে পাহাড়ের মানুষের। কখন কোথায় গোলাগুলীর ঘটনা ঘটে, কে কখন হামলা করে, কে অপহৃত হয়-সেই শঙ্কা নিয়ে পাহাড়ে চলাচল করছে মানুষ।

গত মঙ্গলবার মোয়ালপি পাড়া থেকে আতঙ্কের মধ্যে ৪৯টি মারমা পরিবার বাড়ি ছেড়ে আসার পাঁচদিনের মাথায় এই গোলাগুলীর ঘটনা ঘটলে বম সম্প্রদায়ের মানুষও পাড়া ছেড়ে যায়। রুমা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই মনির হোসেন বলেন, সেদিন ভোর ৪টা থেকে মুয়ালপি পাড়ায় ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক ও কুকি-চীন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএফ) মধ্যে গোলাগুলীর ঘটনা ঘটেছে বলে জানতে পেরেছি। থেমে থেমে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এই গোলাগুলী হয়েছে। এরপর আর গোলাগুলী শোনা যায়নি। মনে হয়, আপাতত বন্ধ আছে। এ ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি বলে জানান ওসি। স্থানীয়রা জানান, উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মোয়ালপি পাড়ায় মূলত মারমা ও বম সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস। এখানে ৫০টির মতো মারমা পরিবার এবং ৮০টির মতো বম পরিবার বাসবাস করে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি এই গ্রামে পৌঁছাতে হেঁটে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। বৃহস্পতিবার ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে এই পাড়া থেকে ৪৯টি মারমা পরিবার বাড়ি থেকে এসে রুমা উপজেলা সদরে মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ভবনে আশ্রয় নেয়। তখন পাড়াবাসী জানিয়েছিলেন, তাদের পাড়া থেকে দুজনকে কেএনএফ (যা স্থানীয়দের কাছে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত) ধরে নিয়ে যায় এবং নির্যাতন করে। পরে পাড়াবাসীর অনুরোধে ছেড়ে দেওয়া হলেও ১৮ এপ্রিল আবার ধরে নিয়ে যায়। এ নিয়ে গত ১৯ এপ্রিল রুমা বাজারে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হলে মুয়ালপি পাড়াবাসীদের প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকে। ঘরে ঘরে ঢুকে দরজায় আঘাত করে। ভয়ে সবাই পালিয়ে যায়। এর মধ্যে সেখানে দুই সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলীর ঘটনা ঘটল। পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উহ্লা মং মারমা মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, আমিও গোলাগুলীর ঘটনা শুনেছি। তবে সেখানে তো অনেকেই আছে। কাদের কাদের মধ্যে গোলাগুলীর ঘটনা ঘটেছে সেটা জানি না। পাহাড় বাসিন্দাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাচ্ছি। হয়তো তারা পাড়া থেকে চলে গেছে। কোথায় গেছে আমি তাও জানি না।

তথ্যমতে, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় গত দেড় বছরে সন্ত্রাসীদের হাতে কমপক্ষে ৩০ জন নিহত হয়েছেন। বুধবার বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় থংচুল বম নামের এক কার্বারির (পাড়াপ্রধান) গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে কে বা কারা তাকে গুলী করে হত্যা করেছে, সেটা পুলিশ জানাতে পারেনি। বিকেল চারটার দিকে বম জনগোষ্ঠীর রামথারপাড়া থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এরআগে গত ৭ এপ্রিলে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার মাঝামাঝি পাইন্দু ইউনিয়নের খামতাং পাড়া থেকে আটজনের লাশ উদ্ধারের পর কয়েক দিনে খামতাং পাড়া, মুয়ালপি পাড়া, পাইক্ষ্যং পাড়া, ক্যপ্লং পাড়া থেকে আটশর বেশি মারমা, বম, খিয়াং সম্প্রদায়ের মানুষ পাড়া ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। তারা এসে রুমা ও রোয়াংছড়ি সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেন। অনেকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও উঠেন। পাড়াবাসী বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর তাদের অনেকের বাগান পুড়িয়ে দেওয়া হয়, বাড়িঘর ভেঙে মালামাল লুট করা হয় বলেও অভিযোগ করেছেন খিয়াংরা। ঈদের আগ থেকে অনেকেই পুলিশ ও প্রশাসনের আশ্বাস পেয়ে আতঙ্ক ও শঙ্কা মাথায় নিয়েই পাড়ায় ফিরতে শুরু করেন। তার মধ্যে আবার গোলাগুলীর ঘটনা পাড়াবাসীর মনে ভয়ের সৃষ্টি করেছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় কেএনএফ, স্থানীয়ভাবে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত এবং নতুন জঙ্গী সংগঠন ‘জামাতুল আনসার হিল ফিন্দাল শারক্বীয়া’র বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী ও র‌্যাব। কখনও কখনও তাদের মধ্যে গোলাগুলীর ঘটনাও ঘটে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতারাও হাতে তুলেছেন অস্ত্র। আত্মগোপনে থেকে চালাচ্ছেন শান্তিচুক্তি বিরোধী তৎপরতা। গহীন পাহাড়ে আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে আঞ্চলিক নেতারা জোট বাঁধছেন নিজের দেশের বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে শঙ্কিত ও আতঙ্কিত পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষ। পাহাড়ে আসলে হচ্ছেটা কী, কারাই-বা দেশের বিরুদ্ধে করছে ষড়যন্ত্র; এসব প্রশ্ন হচ্ছে জোরালো। জেএসএসের বাইরেও পাহাড়ে তৎপরতা বেড়েছে ইউপিডিএফসহ কয়েকটি সশস্ত্র দলের। তাদের উপস্থিতি ও চলাফেরায় ফের সন্ত্রস্ত অবস্থায় আছে বাংলাদেশের পার্বত্য জনপদ। একেবারে দুর্গম পাহাড়েও তাই লেগেছে চাপা উত্তেজনার আঁচ। তিন দেশের সীমান্তের সবচেয়ে কাছের পাড়া ধোপানীছড়া। ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে এই জায়গাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সশস্ত্র গোষ্ঠীর আনাগোনা বেশি বেড়েছে এর উত্তরের শিপ্রু পাড়া থেকে দক্ষিণে জারুছড়ি পাড়া পর্যন্ত। নতুন করে এলাকাগুলো দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে তারা।

https://dailysangram.com/post/523281