৩০ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:৪৩

একদিকে মডেল নির্বাচন: অন্যদিকে পঞ্চদশ সংশোধনী: এটা কি কাঁঠালের আমসত্ত্ব?

-আসিফ আরসালান

বিগত ১ মাস গেল পবিত্র সিয়াম সাধনায়। সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা ছিল না। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের রাজনীতি যে একেবারে স্থবির অবস্থায় ছিল তা নয়। দেশের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যত না তৎপরতা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল বিদেশে। আবার দেশের মধ্যেও কোনো কোনো দূতাবাসে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। গত ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেনের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠককে অনেকে বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণী বৈঠক বলেও অভিহিত করেছেন।

এসম্পর্কে ইতোমধ্যেই পত্র পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। সেজন্য ঐ বিষয়টি নিয়ে আর কথা বলবো না। কিন্তু ঐ বৈঠকের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশেও।

মোমেন সাহেব দেশে ফিরে দু’দিন পর সিলেটের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় বলেন যে আমেরিকা বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না। তিনি আরো বলেন যে আমেরিকা বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীই নির্বাচন চায়। তার এই বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ মহল উল্লসিত হয়। কিন্তু তার পরদিনই মার্কিন দূতাবাস থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। ঐ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে ওয়াশিংটনের বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন বলেছেন যে আমেরিকা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এমন অবাধ ও সুষ্ঠু যে সেটি যেন সারা দুনিয়ায় মডেল নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়। সারা দুনিয়া তাই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে।

বৃহস্পতিবার ২৭ এপ্রিল অপর একটি খবরের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। খবরটি দেখলাম দৈনিক মানব জমিনের অনলাইন সংস্করণে। খবরটির শিরোনাম, কঠোর বার্তা দিয়েছে ওয়াশিংটন, ‘গোটা পৃথিবী বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে’। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভ’ নামক একটি সাময়িকীতে এই কলামটি প্রকাশিত হয়েছে। এই সাময়িকীটির বক্তব্য এই কারণে গ্রহণযোগ্য যে পত্রিকাটি সম্পাদনা করছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি. মাইলাম। মি. মাইলাম যখন বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন তখন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল সমূহের সাথে তার নিয়মিত এবং ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আলোচ্য রিপোর্টে বলা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিজের সবচেয়ে স্পষ্ট বার্তাটি পাঠিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। সেটি হচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক অব্যাহত রাখার জন্য একটি দ্রুত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অপরিহার্য। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি হাই-প্রোফাইল সফরের পরপরই ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে. ব্লিঙ্কেন- এর মধ্যে গত ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকের সময় এই বার্তা দেয়া হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের শুরুতে সংক্ষিপ্ত কিন্তু জোরালো বক্তব্যে সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ওপর জোর দেন। তিনি "বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, মানব ও শ্রম অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রচারে মার্কিন প্রতিশ্রুতি" এর কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।

এসব কথা যে সঠিক তার প্রমাণ মেলে ঢাকায় ড. মোমেন ফিরে আসার পর। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে সিলেটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে আমেরিকার অবস্থান নিয়ে মোমেন যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেটি পরোক্ষভাবে মার্কিন দূতাবাসের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। মোমেনের বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই বিএনপির মধ্যে অশ^স্তি সৃষ্টি হওয়ার কথা। সম্ভবত সেকারণেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারির ১ দিন পর বিএনপিকে তার বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে মির্জা ফখরুল, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং শামা ওবায়েদ গিয়েছিলেন। দেড় ঘণ্টা পর বৈঠক থেকে বেরিয়ে মির্জা ফখরুল স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন যে এই সরকারের অধীনে কোনো রকম নির্বাচনে বিএনপি যাবে না।

মির্জা ফখরুলরা পিটার হাসের সাথে বৈঠকের ১ দিন পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আরো একটি বড় প্রতিনিধি দল নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে তার অফিসে সাক্ষাৎ করেন। এখানে একটি বিষয় খুব সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। সেটি হলো, বিএনপিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিজে আলোচনার জন্য তার বাস ভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কোনো আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানাননি। তাই ওবায়দুল কাদের নিজ থেকেই অফিসে গিয়ে পিটার হাসের সাথে কথা বলেন।

॥দুই॥
রাজনৈতিক তৎপরতা এখানেই থেমে থাকেনি। পিটার হাসের সাথে কথা বলার পর মির্জা ফখরুল জরুরি ভিত্তিতে বিএনপির অবিসংবাদিত নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেন। এরমধ্যে আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটে। যেদিন মোমেন ওয়াশিংটন রওয়ানা হন সেদিন মন্ত্রী র‌্যাঙ্কের একজন স্পেশাল চীনা দূত অত্যন্ত গোপনে ঢাকা সফর করেন। ঢাকার এক শ্রেণীর পত্র পত্রিকায় বলা হয় যে চীন সরকার নাকি চেয়েছিল যে তাদের ঐ বিশেষ দূতের সফর যেন গোপন রাখা হয়। এরপর চীনে ফিরতি সফর করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। এই সফরও গোপন রাখা হয়। সেটিও নাকি চীন সরকারের অনুরোধে।

যেদিন মোমেন ওয়াশিংটন রওয়ানা হন তার ২৪ ঘণ্টা আগে জাতীয় সংসদে বক্তব্য রাখার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে পৃথিবীব্যাপী রেজিম চেঞ্জের ক্ষমতা রয়েছে আমেরিকার। তারা বাংলাদেশেরও সরকার পরিবর্তন চায় এবং গণতন্ত্রের বিলুপ্তি চায়। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান। এর দুই একদিন পর বাংলাদেশের জেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদেরকে সতর্ক করে দেন যে বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র চলছে। সকলে যেন সতর্ক থাকে।

এসব ঘটনাবলীর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ১৫ দিনের লম্বা সফরে দেশ ত্যাগ করেছেন। প্রথমে জানা গিয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী ৪ দিনের সফরে জাপান যাবেন। তারপর জানা গেল যে তিনি আমেরিকা যাবেন। উদ্দেশ্য, বিশ^ ব্যাংকের সভায় যোগদান করা। আমেরিকায় প্রধানমন্ত্রী মার্কিন সরকারের কোনো ঊর্ধ্বতন নেতা অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কারো সাথে বৈঠকে মিলিত হবেন কিনা সেটি বলা হয়নি। এখনও বলা হয়নি যে তিনি সেখানে কোনো হাই ডিগনিটারির সাথে দেখা করবেন কিনা। আমেরিকায় তিনি কয় দিনের সফরে যাচ্ছেন সেটিও এখনো স্পষ্ট নয়। সবশেষে জানা গেল যে আমেরিকা থেকে তিনি ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্য সফরে যাবেন। তার ব্রিটেন সফর কয় দিনের জন্য এবং সেটি পাবলিক না প্রাইভেট সেটিও পরিষ্কার নয়। অন্তত জনগণের কাছে নয়। এমন একটি অস্পষ্ট কর্মসূচি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ১৫ দিনের জন্য দেশের বাইরে গেছেন।

॥তিন॥
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোমেন আমেরিকাতে যেমন বলেছেন তেমনি বাংলাদেশেও একাধিক জায়গায় বলে যাচ্ছ্নে যে বাংলাদেশে মডেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। স্বাভাবিকভাবেই সিভিল সোসাইটির অনেক সদস্য প্রশ্ন তুলেছেন যে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর কি মডেল নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব? ঐ সংশোধনীতে রয়েছে যে পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় বর্তমান পার্লামেন্ট বহাল থাকবে এবং বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পঞ্চদশ সংশোধনী এবং সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দেওয়ার মতো মডেল নির্বাচন কি পাশাপাশি যেতে পারে? এটিকে অনেকে কাঁঠালের আমসত্ব বলে মনে করেন। এসম্পর্কে আজ আর আমি কথা বলবো না। আগামীতে বিষয়টি সংগ্রামের সম্মানিত পাঠক ভাইদের সামনে বিস্তারিত আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ।

ঈদের রেশ কাটতে শুরু করেছে। যখন এই লেখাটি প্রকাশিত হবে তখন রেশ মোটামুটি কেটে যাবে। বিএনপি তার মিত্রদেরকে সাথে নিয়ে আগামী ১লা মে থেকে আবার মাঠে নামবে। হয়তো আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে বিএনপি তথা বিরোধী দল সমূহের পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে জানা যাবে।

॥চার॥
শেষ করার আগে একটি তথ্য দিতে চাই। তথ্যটি আমার নয়। কিন্তু পাঠকভাইদের সেটি জানা প্রয়োজন। যারা সচেতন পাঠক অথবা যারা রাজনীতি সচেতন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে বেগম জিয়া শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে চান না বা কথা বলতে চান না। এই ধরনের প্রোপাগান্ডা আওয়ামী লীগ সর্বদাই করে থাকে। কিন্তু বিএনপি সময় মতো আওয়ামী প্রোপাগান্ডার জবাব দিতে পারে না। এ প্রোপাগান্ডার আংশিক জবাব দিয়েছেন বিএনপির প্রভাবশালী নেতা বিশিষ্ট শিল্পপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু। এ সম্পর্কে গত ১৬ এপ্রিল রবিবার দৈনিক মানব জমিনে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তার অংশবিশেষ নি¤œরূপ:

“২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাকে পাঠিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘যখন ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা হলো, আমি সেদিন ছিলাম দিল্লি। আমাকে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ইমার্জেন্সি ডেকে নিয়ে আসলেন। পরদিন ২২শে আগস্ট সকালে আমি ঢাকা আসি। ২৩ আগস্ট থেকে পরবর্তী মাসের ৭/৮ তারিখের ভেতরে খালেদা জিয়া অন্তত ৫/৬ বার আমাকে শেখ হাসিনার কাছে পাঠিয়েছেন।” তিনি আরো বলেন, “২৩ আগস্ট ঘুম থেকে উঠে শুনলাম যে আমাকে দুপুর ২টার দিকে বেগম খালেদা জিয়া যেতে বলেছেন। যাওয়ার পর অনেক কথা হলো। খালেদা জিয়া আমাকে বললেন, আপনি ওনার (শেখ হাসিনা) কাছে যান। ওনাকে বুঝান। এরপর আমি কমপক্ষে ৫/৬ বার তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘এখন তো এভাবে কেউ যেতে পারবে না। আমিওতো যেতে পারবো না।’”

এই ধরনের আরো অনেক কাহিনী রয়েছে। রয়েছে অনেক রহস্য। সেই সব কাহিনী এখনও অনেক মানুষের অজানা। আর সেই সব রহস্য এখনো অনুদ্ঘাটিত। বাংলাদেশের মানুষের এসব কাহিনী জানা প্রয়োজন এবং এসব রহস্য উদ্ঘাটিত হওয়া প্রয়োজন। আমি ১৯ বছর ধরে সংগ্রামে এই কলাম লিখে যাচ্ছি। আগামীতে রাজনীতি সাংঘর্ষিক না হলে এই ধরনের কিছু কিছু কাহিনী আমি মঞ্চের নেপথ্য থেকে সামনে নিয়ে আসার আশা রাখি। বাকিটা সময় ও সুযোগের ওপর নির্ভর করবে।

https://dailysangram.com/post/523243