২৯ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ৯:৩৬

চিঠি চালাচালিতেই সাত বছর পার বেতন মিলছে না ৭৭৮ শিক্ষকের

৭ বছর ধরে বেতন মিলছে না ৭৭৮ শিক্ষকের। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন ডিগ্রি কলেজের এই শিক্ষকরা বেতন না পেলেও নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষা নিয়ে যাচ্ছেন। বেতন না পাওয়ায় তারা পরিবার নিয়ে অসহায় দিন যাপন করছেন। ডিগ্রি পাস কোর্সের অনুমোদন ও শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালায় পরস্পরবিরোধী তথ্য যুক্ত থাকায় বেধেছে বিপত্তি। এই শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হবেন এমন ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নিয়োগের শর্তে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালায় বলা আছে, স্নাতক (পাস) কোর্স চালুর জন্য বিষয়ভিত্তিক ৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ২০১৮ সালে নতুন করে জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, ডিগ্রি (পাস) কলেজে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ ছাড়াও প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক বাংলা ২ জন, প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক ইংরেজি ২ জন, প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক তথ্যপ্রযুক্তি ২ জন, প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক ঐচ্ছিক বিষয় চালু থাকলে ২ জন হবে। এসব শিক্ষকই এমপিওভুক্তি পাবেন। দুই প্রতিষ্ঠানের বিপরীত অবস্থানের কারণে কলেজে ডিগ্রির ২ শিক্ষক এমপিওভুক্ত হলেও তৃতীয় শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হতে পারছেন না।

জানা যায়, এমপিওভুক্তি ডিগ্রি কলেজের জনবল কাঠামো-২০১০ প্রকাশের পরে বিধি মোতাবেক সারা দেশে ৮৪১ জন তৃতীয় শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন (বর্তমানে কর্মরত ৭৭৮)। এই শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা হলে সরকারের বার্ষিক ২৫ কোটি ১ লাখ ১৩ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয় হবে।

বেসরকারি ডিগ্রি কলেজের তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য ১২টি নির্দেশনা দিয়েছে মাউশি। ১২ শর্তের মধ্যে রয়েছে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ডিগ্রিস্তর এমপিওভুক্ত থাকতে হবে; নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষকের নিয়োগকালীন কাম্য যোগ্যতা এবং বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কর্মরত থাকা; নিয়োগ করা হয়নি এমন প্রতিষ্ঠানে নতুনভাবে কোনো তৃতীয় শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে না; কলেজে নিয়োগ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ও ধারাবাহিকভাবে কর্মরত থাকতে হবে, নিয়োগ প্রক্রিয়ার কাগজপত্রে স্নাতক (পাস) স্তর তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের প্রমাণ, অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের কোনো শিক্ষকের যুক্ত করা যাবে না; নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা থাকায় সদ্য সরকারিকৃত কোনো কলেজের শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করা হবে না; সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হালনাগাদ অধিভুক্ত থাকতে হবে; প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ’র সনদ থাকতে হবে; উল্লিখিত শর্ত পূরণ করে কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষকের নামের তালিকা পাঠালে তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা; আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে শিক্ষকদের নামের তালিকা যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে নিজস্ব দপ্তরে জেলাভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করে মাউশিতে পাঠাতে হবে।

শিক্ষকরা বলছেন, দুই প্রতিষ্ঠানের যাঁতাকলে পিষ্ট তারা। মিলছে না বেতন। রংপুর জেলায় কর্মরত শিক্ষক জাহিদ মণ্ডল বলেন, ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষক গভর্নিং বডির আওতায় নিয়োগ হয় ২০১৬ সালের আগে। এরপর ২০১৬ সাল থেকে (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) এনটিআরসিএ’র আওতায় নিয়োগ শুরু হয়। কিন্তু এই নিয়োগগুলো হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনে। ২০১৬ সালের জুন মাসে একটি তালিকা হয়, যা ছিল ভুলে ভরা। যার কারণে ২০২২ সালের জুন মাসে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এতে বলা হয়, প্রতিটি বিভাগে ২০১৬ সালের পূর্বে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত তাদের তালিকা করার জন্য। এই তালিকা করার জন্য সকল কাগজপত্র নিয়ে সশরীরে প্রার্থীদের শিক্ষা অফিসে ডাকা হয়। গত বছরের জুনে এই তালিকা হবার পর তা যায় (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর) মাউশিতে। এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে নিয়োগ ও পূর্বে নিয়োগের ৭৭৮ জন এমপিওভুক্ত বঞ্চিত হয়। এরপর অন্য একটি চিঠি জারি হয় চলতি বছরের ১৫ই মার্চ। এই চিঠিতে প্রতিটি শিক্ষকের কাম্য শিক্ষার্থীর (শিক্ষার্থীর সংখ্যা) তথ্য চাওয়া হয়, এমপিওভুক্ত করার জন্য। কিন্তু এই চিঠি এখন পর্যন্ত বিভাগীয় পর্যায়ে পৌঁছাইনি। তাদের কোনো তাড়া নেই। আমরা ৭ বছর বেতন বঞ্চিত। এ নিয়ে তাদের কোনো তোড়জোড় নেই।

তিনি দ্রুত এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়ে বলেন, ডিগ্রির তৃতীয় শিক্ষকরা চাকরি করে যাচ্ছে কিন্তু বেতন মিলছে না। কষ্টে দিন কাটাচ্ছি আমরা। দীর্ঘদিন ধরেই চিঠি চালাচালি চলছে। এই বছরের মার্চের ১৫ তারিখ চিঠি হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এই এক চিঠি চালাচালি করতেই তাদের ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় লাগে। আমাদের কথা, এই কাম্য শিক্ষার্থীর তথ্য (বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো) ব্যানবেইস থেকেই সংগ্রহ করতে পারতো। এই তথ্যগুলো সব ব্যানবেইসেই ছিল। সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করলে প্রক্রিয়া দীর্ঘ হতো না।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুস সালাম হাওলাদার বলেন, এই শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ তাদের বিষয়ে ভাবছে। তবে এটা একটা বড় বিষয়। এই শিক্ষকরা যাদের পড়াচ্ছেন তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত বেতন তা কলেজেই থাকছে। তারা প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু পাচ্ছেন না। অনেক শিক্ষকের নিয়োগ আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও দেয় নাই। সার্বিকভাবে এটা অনেক ঝামেলাপূর্ণ বিষয়। সরকার ঢালাওভাবে কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এই শিক্ষকদের সদস্যা সমাধানের উদ্যোগ হাতে নেয়া কঠিন। তবে আমরা এই শিক্ষকদের বিষয়ে ইতিবাচক।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে এক অনুষ্ঠানে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, আমরা মনে করি ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের প্রয়োজন আছে। কারণ কোর্সের যে কলেবর ও সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে তাতে দু’জন শিক্ষকের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা সব সিদ্ধান্ত এককভাবে নিতে পারি না। তবে আশা করছি বিষয়টি বিবেচনা করে সমাধানে আসা সম্ভব হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=53059