২৯ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ৯:৩৩

নতুন শঙ্কা প্রাণঘাতী মাদক আইস

ইয়াবার কারখানায় তৈরি হচ্ছে আইস

দেশের সবচেয়ে প্রচলিত মাদক ইয়াবায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একটি প্রজন্ম। গত এক যুগে ব্যাপকভাবে এই মাদকটির বিস্তার হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই নতুন শঙ্কা তৈরি করেছে ইয়াবার চেয়ে অন্তত ২৫-৩০ গুণ বেশি শক্তিশালী মাদক আইস বা ক্রিস্টাল মেথ। ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের তিনটি রুট দিয়ে অবাধে ঢুকছে এই মাদক। এক সময়ের ইয়াবা কারবারিরাই অধিক লাভের আশায় এখন আইসের ব্যবসা শুরু করেছে। চাহিদা বৃদ্ধিতে মিয়ানমার সীমান্তে গড়ে তোলা হয়েছে আইসের কারখানা। বাংলাদেশের মাদক কারবারিদের কাছে সেগুলো বাকিতেও সরবরাহ করা হচ্ছে। বিভিন্ন হাত হয়ে তা চলে যাচ্ছে মাদকসেবীদের কাছে। অধিক দাম হওয়ায় এবং উচ্চবিত্তদের মধ্যে এর সেবন প্রবণতা বেশি থাকায় এই মাদকের মূল বেচাকেনা চলে অনলাইনে। দেশের এক কোটিরও বেশি মাদকসেবীকে টার্গেট করে গত চার বছরে এভাবে ধীরে ধীরে বিস্তার ঘটেছে আইসের। ছয় মাসের মধ্যে অঙ্গহানিসহ ভয়ংকর সব প্রভাব পড়ছে আইস সেবনকারীদের ওপর।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আইস এখন বড় ধরনের একটি ফ্যাক্টর হয়ে গেছে। এর বিস্তার রোধে আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। একজন পরিচালকের নেতৃত্বে আমাদের একটি টাস্কফোর্স রয়েছে। তারাও কক্সবাজার এলাকায় কাজ করছে। এছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করে উৎসগুলো বন্ধের বিষয়ে বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে আইস এখন প্রধানত তিনটি রুট হয়ে আসছে। সেগুলো হলো-মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশ; মিয়ানমার-মিজোরাম-ত্রিপুরা-বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার-মনিপুর-ত্রিপুরা-ঢাকা। এর বাইরে আফ্রিকানদের মাধ্যমে আকাশপথে কিছু মাদক ঢুকছে। সর্বশেষ বুধবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী এলাকা থেকে ২১ কেজি ক্রিস্টাল মেথ (আইস) উদ্ধার করে বিজিবি। যা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আইসের চালান। জব্দ আইসের আনুমানিক মূল্য ৬৩ কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চালানটিই দেশে আইসের বিস্তারের বড় উদাহরণ। উন্নত বিশ্বে সব আধুনিক প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও মোট মাদকের ১০-১৫ শতাংশ উদ্ধার হয়। সেখানে বাংলাদেশে এই পরিমাণ আরও অনেক কম হওয়ার কথা। এর মানে হলো মোট উদ্ধারের বাইরে আরও ন্যূনতম ৮৫-৯০ শতাংশ ধরা পড়েনি। যা অত্যন্ত ভয়ের বার্তা দেয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা যুগান্তরকে বলেন, ২০১৯ সালে রাজধানীর জিগাতলা থেকে প্রথমবারের মতো উদ্ধার হয় ক্রিস্টাল মেথ বা আইস। আগে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার এই অঞ্চলে এই মাদক ছিল, সেটা এখন আমাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটা দেখতে বরফের মতো। এজন্য এর নাম ‘আইস’ দেওয়া হয়েছে। এটি সেবনের ফলে অনিদ্রা, অতি উত্তেজনা, মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতা, স্মৃতিভ্রম, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভার জটিলতা হতে পারে। আর শরীরের এই ক্ষতিগুলো অনেকটা স্থায়ী রূপ নেয়। কিছু ক্ষতি চিকিৎসার মাধ্যমেও সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়। কারণ ভয়ংকর মাদক ইয়াবাতে অ্যামফিটামিনের পরিমাণ ৫-১৫ শতাংশ। সেখানে আইসে এর পরিমাণ ৯৬ শতাংশ। এ কারণে আইসে ক্ষতির পরিমাণ ইয়াবার চেয়ে অন্তত ২৫-৩০ গুণ বেশি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশে আইস উৎপাদনের খবর তাদের কাছে নেই। বর্তমানে মিয়ানমার সীমান্তে ৩৯টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে। মূলত এই কারখানাগুলো থেকেই বাংলাদেশে ইয়াবা আসে। অতি লাভের কারণে এখন সেখানে ইয়াবার পাশাপাশি আইসও উৎপাদন হচ্ছে। বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে দফায় দফায় জানানো হয়েছে। অথচ কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বেশি কড়াকড়ি থাকলে এগুলো মনিপুর, মিজোরাম ও ত্রিপুরা হয়ে দেশে ঢুকছে। যেহেতু ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষাগত মিল রয়েছে, সে কারণে লেনদেনও সহজ হচ্ছে। এভাবেই আসছে মাদক। এছাড়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। যারা সীমান্তের ওপারে যোগাযোগ রেখে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস্ ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ যুগান্তরকে বলেন, নতুন মাদক সব সময় আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। আইসের বিস্তার রোধে বেশকিছু কৌশল আমরা অবলম্বন করছি। প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছি, কর্মপরিকল্পনাকে সম্প্রসারিত করেছি। আইসের যে চালানটি ধরা পড়েছে, তারা হয়তো মাদকটির এক ফ্লো তৈরির চেষ্টা করছে। বিজিবি তাদের প্রথমেই ধরে ফেলেছে। তিনি বলেন, মিয়ানমারকে তালিকা দিয়ে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে কারখানাগুলো বন্ধের বিষয়ে সব সময় বলে এসেছি। ভারত থেকে যেভাবে সাড়া পাই, তাদের থেকে আসলে ভালো সাড়া পাওয়া যায় না। তারপরও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে মাদক আইসের বাজার তৈরির পেছনে এখানে মাদকের চাহিদা অন্যতম দায়ী। বর্তমানে দেশে মাদকসেবীর পরিমাণ এক কোটিরও বেশি। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই গ্রহণ করে ইয়াবা। আর ইয়াবা গ্রহণকারীদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী ও তরুণ। এক যুগ ধরে মাদকের জগতে ইয়াবা সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করা হচ্ছে। যেহেতু মাদকসেবীরা নিত্যনতুন স্বাদ নিতে চায়, সে কারণেই বাজারে আইস এসেছে। আইসটা তাদের নতুন কৌতূহলে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এই মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। এ সুযোগে মাদক কারবারিরাও বেশি বেশি আইস আনছেন। টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও সিগন্যালের মতো অ্যাপ ব্যবহার করে এগুলো বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা বেশি হওয়ায় মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের কারবারিদের বাকিতেও আইস দেওয়া হচ্ছে। এর কারণ তাদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের ব্যবসা রয়েছে। এতে একের প্রতি অন্যের আস্থা তৈরি হয়েছে।

মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, মিয়ানমারে যারা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল, তারাই এখন আইসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ওই চক্রটিই দেশে আইস ঢুকিয়ে দিয়েছে। আইসের দামও অনেক বেশি। ইয়াবার চেয়ে লাভ বেশি। এজন্য আইস বেশি আসছে। এগুলোর বেশিরভাগই বিক্রি হচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। করোনার সময় থেকে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তরুণরা যখন মাদক বাইরে পাচ্ছিল না, তখন তারা অনলাইনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। মাদক কারবারিরা একটা অ্যাপ ব্যবহার করে। এর মাধ্যমেই তারা কেনাবেচা করে। এ বিষয়ে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের আইটি বিভাগের দক্ষতা বাড়াতে বলেছি। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত নজরদারি বাড়াতে বলেছি।

তিনি আরও বলেন, মানবদেহের ওপর আইসের ভয়ংকর প্রভাব রয়েছে। অনেক দ্রুত এর প্রভাব পড়ে। ছয় মাসের মধ্যে এর সেবনকারীদের অঙ্গহানিসহ বিভিন্ন ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে। আইস ঠেকাতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, এর প্রধান কারণ শস্যখেতে ভূত আছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, রাজনীতিবিদ ও সবার মধ্যেই সেই ভূত রয়েছে। সে কারণে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও ঠেকাতে পারছে না। সীমান্তে নজরদারির ঘাটতি আছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এসব নিয়ে বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। করণীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাদকের বিস্তার রোধে এর সরবরাহ ও চাহিদা বন্ধ করতে হবে। মাদকের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও সুযোগ-সুবিধা এ দেশে নেই। যে কারণে যারাই আসক্ত হচ্ছে তারা আবার ঘুরেফিরে চিকিৎসা নিয়ে ফের গ্রহণ করছে। সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হচ্ছে না। রিহ্যাব সেন্টারগুলো আধুনিক নয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/669429