২২ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১১:২২

জেনারেটর না বসিয়েই ৬০ লাখ টাকা পরিশোধ!

কক্সবাজার বিমানবন্দরের জন্য ৩০০ কেভিএর একটি জেনারেটর দরকার ছিল। সব প্রক্রিয়া শেষে এ জন্য দরপত্রও আহ্বান করা হয়। কাগজপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে জেনারেটর কেনা হয়েছে এবং সংস্থাপনের পর তা যথাযথভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে বাস্তবে কিছুই হয়নি। জেনারেটর বুঝে না পেয়েই ঠিকাদারকে পরিশোধ করা হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। জেনারেটর না বসিয়েই এ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি ছয় মাস ধরে জেনারেটরের জ্বালানি খরচও দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল (সিভিল এভিয়েশন) কর্তৃপক্ষের কিছু প্রকৌশলী মিলে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন। সংস্থাটির উচ্চপর্যায়ের তদন্ত প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এ চিত্র।


অভিযোগ ওঠার পর তা তদন্তে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদস্য (অর্থ) অতিরিক্ত সচিব মিজানুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন নির্বাহী প্রকৌশলী (ই/এম বিভাগ-১) আছির উদ্দিন ও সহকারী পরিচালক (কম. ইঞ্জি সেমসু) এম এম মোসারেফ হোসেন। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে কমিটি এ প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
তদন্ত কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা ঘটনাটি শোনার পর দীর্ঘ সময় ধরে অনুসন্ধান করেছি। সব কিছু পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জেনারেটর না বসিয়েই ৬০ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারকে। সরকারি এ কাজে অনিয়ম যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। ’


তদন্ত প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে যায়, কক্সবাজার বিমানবন্দরে ৩০০ কেভিএ জেনারেটর বসানোর জন্য ২০১৫ সালের ৮ মার্চ ‘মেসার্স ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডার্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। ৯ মার্চ এসংক্রান্ত চুক্তিতে উভয় পক্ষ স্বাক্ষর করে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর একই বছরের ২০ জুলাই কার্য সম্পাদন দেখিয়েছে। কর্তৃপক্ষের এ বইয়ে স্বাক্ষর করেন শহীদুল ইসলাম মণ্ডল (সিনিয়র উপসহকারী প্রকৌশলী), ভবেশ চন্দ্র সরকার (সহকারী প্রকৌশলী), মিহির চাঁদ দে (নির্বাহী প্রকৌশলী)। কার্য সম্পাদন প্রত্যয়নে এ তিনজনসহ সহকারী প্রকৌশলী হাসান জহির, সিনিয়র অ্যারোড্রোম অফিসার ও রক্ষক শহীদুল আফরোজ (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) স্বাক্ষর করনে। ২০১৫ সালের ৩০ জুন ঠিকাদারকে প্রথমবার ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন সিনিয়র হিসাবরক্ষক তুষার কান্তি দেওয়ান ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজ। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তুষার কান্তি দেওয়ান ও ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুউদ্দিন চৌধুরী স্বাক্ষর করে আরো ২০ লাখ টাকার বিল প্রদান করেন। ভবেশ চন্দ্র সরকার ২০১৫ সালের ১৪ মে জেনারেটরটি বিদেশ থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে আসার কথা বললেও তিনি এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান শিপমেন্ট (জাহাজীকরণ) ও শুল্ক ছাড়পত্রের কাগজ দেখাতে পারেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাগজপত্রে ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর সাক্ষাত্কারে জেনারেটরটি ২০ জুন সংস্থাপন হয়েছে মর্মে জানানো হলেও বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক হাসান জহির তা পাশ কাটিয়ে ৮ জুলাই জেনারেটর সংস্থাপনের কথা বলেন। জ্বালানি খরচের নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির দুজন সদস্য ২০১৫ সালের ১ আগস্ট সরেজমিন পরিদর্শন করে সেখানে ৩০০ কেভিএ জেনারেটর পাননি। তদন্ত কমিটি সরেজমিন পরিদর্শনে পাওয়ার হাউসে গিয়ে ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এ জেনারেটর দেখতে পান। সেই সঙ্গে রক্ষিত লগ বইয়ের তথ্য মতে, বিমানবন্দরে জেনারেটরটি প্রবেশের জন্য কর্তৃপক্ষ উল্লিখিত তারিখে অনুমতি দেয় মর্মে জানা যায়। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনে আমেরিকা ব্র্যান্ডের ঈগল জেনারেটর লিমিটেড থাকার কথা থাকলেও নিম্নমানের ‘নাডা ইউরো পাওয়ার ডিজেল’ জেনারেটর বসানো হয়েছে। এসব অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জড়িত মর্মে প্রতীয়মান হয়।


তদন্ত কমিটি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৩ জন কর্মকর্তা/প্রকৌশলীর জবানবন্দি রেকর্ড করে। ঘটনার অন্যতম সাক্ষী কক্সবাজার বিমানবন্দরের সিনিয়র উপসহকারী প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম মণ্ডল তাঁর লিখিত পত্রে বলেন, “২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেট হতে ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা জেনারেটরের জন্য ঠিকাদারকে অর্থছাড় দেওয়া হয়। পরে আরো ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী জেনারেটর স্থাপনের পর অর্থছাড় দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু অর্থছাড়ের দীর্ঘ সময় পরও জেনারেটর না পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট সহকারী প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীকে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও ‘এসে যাবে’, ‘পোর্ট হতে ছাড় করাতে জটিলতা হইতেছে’, ‘ড্রয়িং অ্যান্ড ডিসবার্সমেন্ট কর্মকর্তা হিসেবে তাহারা দায়িত্ব নিবেন’—এমন কথা বলতে থাকেন। এ সময় দুই প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের কথায় অনেকটা গোলমাল মনে হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর সহায়তায় প্রধান প্রকৌশলীকে বিষয়টি জানানো হয়। ”


তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার বিমানবন্দরে জেনারেটর ক্রয় না করে ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা—এমন অভিযোগের পর তদন্ত শুরু করে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি যখন ফাঁস হয়ে যায় তখন তড়িঘড়ি করে একটি পুরনো জেনারেটর বসিয়ে দেয় সংশ্লিষ্টরা। এর আগে জেনারেটর না থাকলেও ছয় মাস ধরে জ্বালানি খরচ হয়েছে দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা নিয়ে যায় তারা। এ তদন্তে জেনারেটর ক্রয়ের কার্যাদেশের তারিখ, চুক্তিপত্রের তারিখ, পরিদর্শন সনদ ইস্যুর তারিখ, কাজটি যথাসময়ে সম্পাদন হয়েছে কি না, প্রত্যয়ন ও বিল পরিশোধ, বিমানবন্দরে জেনারেটর প্রবেশ অনুমতিপত্র, কার্যাদেশ ও চুক্তিপত্রের আলোকে জেনারেটরটি সংস্থাপন হয়েছে কি না এবং শিপমেন্ট (জাহাজীকরণ) তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে জানা যায়।


এ বিষয়ে কথা বলতে ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুদ্দিন চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি তা ধরেননি। তবে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী মিহির চাঁদ দে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা যথাসময়ে জেনারেটর সংস্থাপন করেছি। জেনারেটর বসানোর আগে কোনো বিল দেইনি। এখন তদন্ত কমিটি কেন উল্টোপাল্টা রিপোর্ট দিয়েছে তা বুঝতে পারছি না। শুনেছি ই/এম ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আছির উদ্দিন ঠিকাদারের কাছে চাঁদা চেয়েছিলেন। চাঁদা না পেয়ে হয়তো তিনি খেপে গিয়ে এসব করেছেন। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/04/22/489434