২৮ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৮:১৯

অনুমোদনহীন ছুটি বেড়েছে

দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের অনুমোদন ছাড়া ছুটি কাটানোর প্রবণতা বেড়েছে। এতে একদিকে যেমন নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।

শিক্ষকদের অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপস্থিতি রোধে দেশের বিদ্যালয়গুলোতে গত বছর নভেম্বর থেকে ঝটিকা পরিদর্শন শুরু করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। তাদের এ বিষয়ক প্রতিবেদনে শিক্ষকদের অননুমোদিত অনুপস্থিতি বাড়ার চিত্র দৃশ্যমান। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার পর থেকে শিক্ষকদের অনুপস্থিতির প্রবণতা বেড়েছে। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চল ও দুর্গম অঞ্চলে এ সমস্যা বেশি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়ন শাখার ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কুরবাতুল আয়েন সফদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সারা দেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক ঘাটতি রয়েছে। আবার অনেক শিক্ষক অনুমোদিত বা অননুমোদিত ছুটিতে থাকেন। এতে একটি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে ধারাবাহিক পাঠদান ব্যাহত হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখন ঘাটতি তৈরি হয়। এই ঘাটতি পূরণে আমরা রিমিডিয়াল ক্লাসের ব্যবস্থা রেখেছি। যদিও এসব ক্লাসের প্রচলন এখনো জোরালোভাবে শুরু করা সম্ভব হয়নি।’
মাউশি সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে তাদের আওতাধীন মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০ হাজার ৩১৬। গত জানুয়ারি মাসে দেশের চাঁদপুর, খুলনা, দিনাজপুর,

রাজশাহী ও সিলেট অঞ্চলের ১০টি বিদ্যালয়ে ঝটিকা পরিদর্শনে যান মাউশির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এ সময় ১৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত পাওয়া যায়, যাঁরা কোনো অনুমতি ছাড়াই ছুটিতে ছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশের ৫৫টি বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন এসব কর্মকর্তা। এ সময় ছুটির অনুমোদন ছাড়া বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন ৯৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী।
মাউশির পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অনুমোদন ছাড়া ছুটিতে থাকা শিক্ষকদের মধ্যে বেশির ভাগই সহকারী শিক্ষক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রধান শিক্ষক। এ ছাড়া রয়েছেন সহকারী ইনস্ট্রাক্টরসহ অন্য
কর্মচারীরা। অনুপস্থিত এসব শিক্ষকের মধ্যে দুজন ছুটি ছাড়াই দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাউশির একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদ্যালয়ে আসার সময়সূচি মানার ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষকদের মধ্যে বেশি অনীহা দেখা যায়। বেশির ভাগ শিক্ষক তাঁর খেয়াল-খুশিমতো বিদ্যালয়ে যান। সকাল ১০টার দিকে একটি বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে দেখি, ২২ জন শিক্ষকের মধ্যে উপস্থিত মাত্র পাঁচজন। অনেক শিক্ষক আবার পূর্বানুমতি ছাড়াই ছুটি কাটিয়ে থাকেন। এসব বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের নিয়মিত এবং দৈনিক উপস্থিতি নীতিমালা আছে। এই নীতিমালা কার্যকরের উদ্যোগ নিতে হবে। মাঠ পর্যায়ে কঠোর নজরদারিসহ মাউশির পর্যবেক্ষণ শাখা পর্যন্ত পুরো চেইনে পরিবর্তন আনতে হবে।’

গত ৩ এপ্রিল মাউশির অংশীজনদের সভায় শিক্ষকদের এমন অনুপস্থিতি নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভা সূত্রে জানা যায়, ঝটিকা পরিদর্শনের সময় যেসব শিক্ষক-কর্মচারী কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন, তাঁদের ঢাকায় এসে মাউশিতে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। আবার যেসব শিক্ষক ছুটি ছাড়াই দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকদের মাউশিতে কারণ দর্শাতে ডাকা হয়েছে।

শিক্ষকদের অনুপস্থিতির বিষয়ে মাউশির আইন শাখার এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিনা অনুমতিতে কোনো কর্মকর্তা বা শিক্ষক দেশের বাইরে অবস্থান করলে, তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা যেতে পারে। এতে সর্বনিম্ন সাজা বিনা বেতনে ছুটি প্রদান। গুরুদণ্ড হিসেবে চাকরি পর্যন্ত চলে যাওয়ার বিধান রয়েছে।

মাউশির পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. আমির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদেশে যাওয়া শিক্ষকদের বিষয়ে মাউশিকে না জানানোর কারণে প্রধান শিক্ষকদের আসতে বলা হয়েছে। এসব শিক্ষক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যখন ঢাকায় আসবেন, তখন সময় আর অর্থ দুটোই অপচয় হবে। এই ভোগান্তির বিষয়টি মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের পাশাপাশি অন্যরাও সতর্ক হবেন।

আমির হোসেন বলেন, ‘এর আগে ২০১৯ সালে এমন ঝটিকা পরিদর্শন চালু করা হয়। এতে একসময় অননুমোদিত ছুটি প্রায় শূন্যের ঘরে চলে আসে। করোনার পর আবার শিক্ষকদের মধ্যে অনুপস্থিতির প্রবণতা বেড়েছে। তাই আবার ঝটিকা পরিদর্শন ুশুরু করেছি। আমরা চেষ্টা করছি, শিক্ষকরা যেন অবহেলা না করেন। শিক্ষকদের সতর্ক করাই আমাদের বড় উদ্দেশ্য।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, অনুমোদন ছাড়া শিক্ষকদের ছুটিতে যাওয়া শুধু আইন বহির্ভূত কর্মকাণ্ড নয়, বরং অনৈতিক কাজ। শিক্ষকের দায়িত্ব বাকি ১০ জন সরকারি কর্মকর্তার মতো নয়। তাঁর জবাবদিহি করতে হবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে। জবাবদিহির সেই জায়গায় ঘাটতি থাকলে তিনি শিক্ষক নামের গ্রহণযোগ্যতাই হারিয়ে ফেলবেন।

তিনি বলেন, শিক্ষকদের এমন অনুপস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি তৈরি হওয়ার পাশাপাশি পড়ালেখার উৎসাহে ভাটা পড়ে। শিক্ষকদের অনুপস্থিতির বিষয়টি রাজধানী বা বড় শহরের তুলনায় মফস্বল বা দুর্গম অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। সেখানে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই ভাষা ও গণিতে দুর্বল থাকে। যেখানে শিক্ষকদের বেশি পরিশ্রম করার কথা, সেখানে এমন অনুপস্থিতি হলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়।

অনুমোদন ছাড়াই শিক্ষকদের অনুপস্থিতির জন্য প্রধান তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন শিক্ষাবিদ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই তিন সমস্যার সমাধান করতে না পারলে দিনের পর দিন এসব সমস্যা থেকে যাবে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অনুমোদনহীন অনুপস্থিতির পেছনে যে তিনটি মূল কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন, সেগুলো হলো :
প্রথমত, অন্য চাকরি না পেয়ে শিক্ষকতায় আসা। এ কারণে তাঁরা শিক্ষকতার জন্য তৈরি থাকেন না। আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদানেও তাঁরা ব্যর্থ হন। পেশার ক্ষেত্রে নৈতিক ও বিধিগত দায়িত্ব না থাকায় তাঁরা এসব অনৈতিক কাজ করেন।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বেশ কম। যদি শিক্ষকদের সেভাবে সম্মান ও সম্মানী না দিই, তবে শিক্ষকতা পেশা হিসেবে আকর্ষণীয় হবে না। মেধাবী শিক্ষার্থীরাও আকৃষ্ট হবেন না।

তৃতীয়ত, তদারকি ব্যবস্থা একেবারে দুর্বল। অনেক শিক্ষক রাজনৈতিক কারণে ও অর্থ দিয়ে চাকরি পান। তাঁদের তো নিয়মের অধীনে আনা যায় না। স্কুলগুলোতে এখনো সুষ্ঠু তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা পেলাম না। জবাবদিহির চর্চা শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা তৈরি করতে পারিনি।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/04/28/1274941