২২ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১১:১৪

হার্টের রিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণহীন

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের এক শ্রেণির চিকিৎসক হৃদরোগীদের রিং পরানোর বাণিজ্যে সরাসরি জড়িত। একাধিক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ইত্তেফাককে বলেছেন, বছরের পর বছর চলছে হার্টের রিং পরানো নিয়ে নৈরাজ্য। নিয়ন্ত্রণ করার যেন কেউ নেই। এক শ্রেণির চিকিৎসক যেসব রোগীকে রিং পরানো প্রয়োজন নেই, ঐ সব রোগীদের কমিশনের লোভে হার্টের রিং পরাচ্ছেন।

জানা মতে ১২ জন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক সরাসরি হার্টের রিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। নিম্নমানের রিং উচ্চ মূল্যে ঐ সব চিকিত্সকদের পছন্দের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে রোগীদের ক্রয় করতে বাধ্য করা হয়। নন মেডিকেটেড রিংয়ের মূল্য কম। মেডিকেটেড রিংয়ের মূল্য অনেক বেশি এবং নিরাপদ। কোন কোন কার্ডিওলজিস্ট মেডিকেটেড রিং পরানোর কথা বলে উচ্চ মূল্য রোগীদের কাছ গ্রহণ করেন। কিন্তু ঐ চিকিত্সকই নিম্নমানের মেডিকেটেড হার্টের রিং রোগীকে পরিয়ে দেন। সরবরাহকারী কোন কোন প্রতিষ্ঠান ঐ চিকিত্সকদের কমিশনের পাশাপাশি চেম্বার ও বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ও বিদেশ যাতায়াতের খরচ বহন করে থাকে। এমন অভিযোগ চিকিত্সকদের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়। এক শ্রেণির চিকিত্সক রোগী ও তার পরিবারের সদস্যদের এনজিওগ্রাম পরীক্ষা করার সময় কিংবা আগে বলে দেন যে, রিং পরানোর জন্য টাকা নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। এনজিওগ্রাম করার সময় রোগীর রিং পরানোর প্রয়োজন নেই কিংবা কয়েক মাস পরে পরানো হলেও কোন সমস্যা নেই। ঐ সব রোগীকে এমন সব কথা কমিশন লোভী কার্ডিওলজিস্টরা বলে থাকেন, যা রোগী ধার দেনা করে হলেও রিং পরতে বাধ্য হয়। কমিশন লোভী চিকিত্সকদের খুশি রাখতে কোন কোন আমদানিকারক নিম্নমানের রিং উচ্চ মূল্যে বিক্রি করছে এমন তথ্য পাওয়া যায়। হার্টের রিং রোগীকে পরানোর আগে কার্ডিওলজিস্ট, কার্ডিয়াক সার্জন ও অ্যানেসথেসিওলজিস্ট সমন্বয়ে গঠিত টিমের মতামত নিতে হয়। এ মতামতের প্রেক্ষিতে রিং পরানো হলে রোগী নিরাপদ থাকেন ও অন্যান্য ঝুঁকি কম হয়। সরকারি ও বেসরকারি দুইটি হাসপাতাল ব্যতীত অধিকাংশ হাসপাতালে এ ধরনের কোন টিম নেই। কমিশন লোভী চিকিত্সকরা নিজেরাই ইচ্ছামত হার্টের রিং পরিয়ে যাচ্ছেন। তাদের দাপটের কাছে হাসপাতাল প্রধান কিংবা মালিকরা অসহায়। এমন অভিযোগের সত্যতা একাধিক হাসপাতাল প্রধান ও মালিক স্বীকার করেছেন।

নিম্নমানের ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে রিং পরানোর কারণে রোগীরা নানা জটিলতার শিকার হয়। পরে বিদেশ গিয়ে রিং বাণিজ্যের বিষয়টি ধরা পড়ে। বিদেশি হূদরোগ বিশেষজ্ঞরা রোগীকে জানিয়েছেন যে, তোমাকে যে রিং পরিয়েছে অপ্রয়োজনীয় ও নিম্নমানের। এ কারণে তোমার হার্টের জটিলতা অনেক গুণ বেড়ে গেছে। এ জটিলতায় অনেক রোগী পরবর্তীতে মারা যায়। রিং বাণিজ্যের কবলে পড়ে অনেক নিরীহ ও অসহায় রোগী সর্বশ্বান্ত হয়ে গেছে।

এ নৈরাজ্য ঠেকাতে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে একাধিক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমানকে সভাপতি করে হার্টের রিং মূল্য নির্ধারণে কমিটি গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে কমিটি মূল্য নির্ধারণ করার কার্যক্রম শুরু করলে আপত্তি আসে আমদানিকারকদের পক্ষ থেকে। এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন কমিশন লোভী কার্ডিওলজিস্টগণ। মূল্য নির্ধারণ হলে তাদের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। আমদানিকারকদের হার্টের রিং সরবরাহ বন্ধ করতে পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। গত বুধবার ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের বৈঠকে হার্টের রিং মূল্য নির্ধারণ নিয়ে বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। একপর্যায় আমদানিকারকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, মূল্য নির্ধারণ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কারণে তারা আপত্তি তোলেন। একদিন রিং সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হার্টের রিং নিয়ে অনুরূপ বাণিজ্য চলছিল দীর্ঘদিন। ভারতের সংসদে রিং বাণিজ্য ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়। সুপ্রীম কোর্ট থেকে সুস্পষ্ট ভাষায় সরকারকে জানিয়ে দেয় যে, অবিলম্বে হার্টের রিং নিয়ে হূদরোগীদের হয়রানি ও বাণিজ্য বন্ধ করা না হলে একতরফা রায় দেওয়া হবে। ভারত সরকার হার্টের রিং মূল্য নির্ধারণ করেছে। সর্বোচ্চ ২৯ হাজার ভারতীয় রূপি ও সর্বনিম্ন ৭ হাজার ২০০ রূপি। এ মূল্যের বাইরে যদি কোন আমদানিকারক রিং বেশি মূল্যে বিক্রি করে, ঐ আমদানিকারকের ব্যবসা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ এবং আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাকিস্তান ও শ্রীলংকা সরকার হার্টের রিং নিয়ে ভারতের ন্যায় একই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. একেএম মহিবুল্লাহ বলেন, ওষুধের গায়ে এমআরপি (মূল্য নির্ধারণ) ও ব্যবহারের সময়সীমা উল্লেখ থাকে। অনুরূপভাবে হার্টের রিংয়ের প্যাকেটে এমআরপি ও ব্যবহারের সময়সমাি উল্লেখ থাকা রোগীদের জীবন রক্ষার্থে বাধ্যতামূলক। মূল্য নির্ধারণে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। মূল্য নির্ধারণ না মানলে যে ধরনের ব্যবস্থা নিবে সরকার তাও সোসাইটির পক্ষ থেকে সমর্থন দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব কার্ডিওভাসর্কুলার ইন্টারভেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমান বলেন, এ ইনস্টিটিউটে হার্ট টিম রয়েছে। এ টিমের মতামত অনুযায়ী রিং পরানো হয়ে থাকে। হার্টের রিংয়ের মূল্য নির্ধারণে এই সোসাইটির পক্ষ থেকে সরকারকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। মূল্য নির্ধারণ হলে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে একই মূল্যে রিং বিক্রি হবে। মূল্য নির্ধারণ হলে রোগীরা উপকৃত হবে। তিনি সরকারের মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্য।

দুই শীর্ষস্থানীয় কার্ডিওলজিস্ট ইত্তেফাককে জানান, মূল্য নির্ধারণ ও ব্যবহারের সময়সীমা উল্লেখ থাকলে রোগীরা প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাবে। স্বল্প মূল্যে রিং পরানোর সুযোগ পাবেন। বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাস পাবে বলে উক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা জানান।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, হার্টের রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ করা হবেই। এ নিয়ে কার্যক্রম চলছে। দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।

http://www.ittefaq.com.bd/national/2017/04/21/111505